বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪

| অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

পরীক্ষামূলক

হাওর বাংলা প্রতিদিন.কম || HaorBangla Protidin.com

হাওরবাংলাপ্রতিদিন.কম : জাগোক ধূমকেতুর শক্তিতে

রফিকুল ইসলাম

প্রকাশিত: ০৪:৩৮, ২৫ এপ্রিল ২০২১

আপডেট: ০৫:২৩, ২৫ এপ্রিল ২০২১

হাওরবাংলাপ্রতিদিন.কম : জাগোক ধূমকেতুর শক্তিতে

১.           ''আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু
                    আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,
                     দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
              উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
                 গা মেরে তুই জাগিয়ে দেরে
                    আছে যারা অর্ধচেতন।"

২. এমনি বজ্র পঙক্তিতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'ধূমকেতু'র বিদ্রোহী সম্পাদক কাজী নজরুল ইসলামকে জানিয়েছিলেন আগামী পথচলার সংগ্রামী শুভেচ্ছা; যা পত্রিকার প্রথম পাতার শীর্ষে উৎকীর্ণ থাকতো। মুজিব জন্মশতবর্ষ, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ও বাঙালির সত্তা পয়লা বৈশাখের মহিমান্তিত লগ্নে সংবাদপত্রের জগতে শুকতারা হয়ে উদিত হতে যাচ্ছে 'হাওরবাংলা প্রতিদিন.কম' অনলাইন পত্রিকা। পত্রিকাটির চলার পাথেয় যেন হয় কবি আবু হেনা মোস্তাফা কামালের ভাষায়-- 'হয় বাঘ, কিংবা বাঘ নয়; সৌখিন বাঘ বলে কিছু নেই।'

৩. "...এ দেশের নাড়ীতে নাড়ীতে অস্থিমজ্জায় যে পচন ধরেছে, তাতে এর একেবারে ধ্বংস না হলে নতুন জাত গড়ে উঠবে না। ...দেশের যারা শত্রু, যা কিছু মিথ্যা, ভন্ডামী, মেকি ইত্যাকার দূর করতে 'ধূমকেতু' হবে আগুনের সম্মার্জনী।"

৪. এই উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে ১৯২২ সালের ১২ আগস্ট প্রকাশিত অর্ধ-সাপ্তাহিক 'ধূমকেতু' পত্রিকাটি উপমহাদেশীয় সাংবাদিকতার ইতিহাসে স্বরাজের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তুলে সূচনা করে অগ্নিযুগের। স্বাধীনতার দাবিতে আগুনের ভাষায় লেখা সম্পাদকীয়, নিবন্ধ এবং সংবাদপত্রের ওপর ব্রিটিশ সরকারের সেন্সরশীপের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনার জন্য কবি নজরুলকে করতে হয় কারাবরণ। কবি নজরুল একদিকে প্রেমিক, অন্যদিকে বিদ্রোহী। এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আরেক হাতে রণ-তূর্য। সুরের নেশায় মত্ত, অসুরের বিরুদ্ধেও সোচ্চার যত। জাতির দৈন্য ও ক্লেশ তাড়া করত সবসময়। সেই তাড়নায় সমাজকে জাগিয়ে তুলতে এবং জনমত গঠনে দায়িত্ব নেন তথ্য প্রকাশেরও। তাঁর 'ধূমকেতু'র নীতি ছিল সাংবাদিকতার মাধ্যমে জনসেবা, উন্নয়ন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা এবং জনগণকে সংগ্রামমুখী করে তুলে স্বাধীনতা অর্জন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, 'মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই--নহে কিছু মহীয়ান'। মা মাটি ও মানুষ এবং মানবতার কল্যাণের জন্য কলম ধরেছেন ধূমকেতুর শক্তিতে-- "শির দেগা, নাহি দেগা আমামা।" অর্থাৎ, 'মাথা দেবো, দেবোনা আত্মসম্মান ও স্বাধীনতা।'

৫. 'ধূমকেতু'র পূজার সংখ্যায় 'আনন্দময়ীর আগমনে' কবিতা প্রকাশের দায়ে কাজী নজরুল ইসলাম গ্রেফতার হন। হুগলি জেলে কর্মকর্তাদের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে তিনি অনশন শুরু করলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর টেলিগ্রাম পাঠান-- "Give up hunger strike 0ur literature claims you."

৬. এর আগে ১৯২০ সালে কবি নজরুল ছিলেন 'সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ' পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক। পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন রাজনৈতিক নেতা কমরেড মোজাফফর আহমদ ও শেরেবাংলা এ.কে ফজলুল হকও। কবিরই সম্পাদনায় ১৯২৫ সালে প্রকাশিত হয় আরেকটি পত্রিকা-- 'লাঙ্গল'।

৭. "যেখানে দেখিবে ছাই /উড়াইয়া দেখ তাই /পাইলেও পাইতে পার মানিক রতন"-- সত্যব্রতে এই কনসেপ্টিই হোক 'হাওরবাংলা প্রতিদিন.কম' অনলাইন পত্রিকাটির অভিষেক। কেননা, মফস্বলীয় উন্নাসিকতা ও মনস্তাত্ত্বিক সংকীর্ণার তথ্যসাগরের ডুবুরি যে আমরা। প্রখ্যাতির পেছনে ছুটে পাতিকে পাত্তা দিচ্ছি ক'জনা। প্রসঙ্গত, অখ্যাত এক লেখক বই প্রকাশ করতে তার লেখা পান্ডুলিপি নিয়ে হেন কোনো প্রকাশনী নেই ধর্না দেননি। পাতি বলে পাত্তা না পেয়ে ওপারের প্রখ্যাত লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা একটি বই কপিরাইট করে নিয়ে গেলে প্রকাশক পড়ে তা ছুড়ে ফেলে 'হাবিজাবি' এ লেখার জন্য ভর্ৎসনা করেন এবং ফের চৌকাট না মাড়ানোর শোনান সাবধানবাণীও। ওই লেখক আর কেউ নন, এপারের এই যুগের সেরা কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। প্রখ্যাতিতে 'মুই কি হনুরে' বনা ভেস্তে যাবে Genealogy ঘাঁটলে। রাজধানী ভিত্তিক কতক জাতীয় গণমাধ্যমেরও হুঁশ ফিরুক-- "সুজনে সুযশ গায় কুযশ ঢাকিয়া, /কুজনে কুরব করে সুরশ নাশিয়া।"

☞ সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার শিকড়সন্ধান:
৮. সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার শিকড় মফস্বলেই প্রোথিত। উপমহাদেশের প্রথম পত্রিকা হিকির 'বেঙ্গল গেজেট' (১৭৮০ খ্রি.)। উপমহাদেশের বাংলা ভাষায় প্রথম পত্রিকার পথচলার শুরুটা হয়েছিল 'দিকদর্শন' ( এপ্রিল ১৮১৮ খ্রি.) -এর মাধ্যমে। বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা 'রংপুরবার্ত্তাবহ' (১৮৪৭ খ্রি.) এর প্রায় একদশক পর প্রকাশিত হয় ঢাকার প্রথম পত্রিকা 'ঢাকা নিউজ' (আগস্ট ১৮৫৬ খ্রি.) এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা 'দৈনিক আজাদী (১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ খ্রি.)। অথচ সাংবাদিকতার 'সাং'কে (শিকড় অর্থে) ''বা'দিক' ফেলে ''তার'কায়" কাতর এক শ্রেণির গণমাধ্যম। ফলে 'আকডুম বাকডুম'ও পায় স্পেস ও হাইয়ার ট্রিটমেন্ট। প্রখ্যাতির পুঁজিতে সাংবাদিকতায় এটাও এক প্রকার বাণিজ্যিক বোলচাল। নামেই নাকি কাটতি। অবশ্য সবাই তাতে গা ভাসায় না। কারণ হলো-- অনেক তারকারাজিই আছে, যাদের আলোকচ্ছটা আজো পৌঁছেনি মানবজমিনে; যা জোনাকি ছড়ায়। জোনাকির সম্মিলিত আলোকচ্ছটায় শুকতারা হয়ে উঠুক 'হাওরবাংলা প্রতিদিন.কম'।

৯. আমরা যারা রাজধানীতে জাতীয় পত্রিকায় আছি, দেমাগে অনেকেরই পা পড়ে না মাটিতে। উদাহরণও রয়েছে। অথচ ঢাকার প্রথম সংবাদপত্র হলো 'ঢাকা নিউজ'। এটা শুধু ঢাকার প্রথম সংবাদপত্রই নয়, পূর্ববঙ্গ থেকে প্রকাশিত প্রথম ইংরেজি সাপ্তাহিকও। ঢাকায় প্রথম মুদ্রণযন্ত্র এনেছিলেন ব্যাপটিস্ট মিশিনারিরা ১৮৪৭ সালে। মূখ্যত মিশিনারিদের প্রচারপত্র ও রিপোর্ট ছাপার জন্য তা ব্যবহৃত হতো। পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন আলেকজান্ডার ফর্বেস। পত্রিকাটি প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৮৫৬ সালের ২৬ এপ্রিল। পত্রিকার সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করা হয়েছিল, এটি একটি 'মফস্বল জার্নালই' হতে চায়। এতে দুটি উদ্দেশ্যের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল-- প্রথমত, নেটিভ বা স্থানীয়রা ইংরেজদের থেকে ভিন্ন নয় এবং অনুকূল পরিবেশে তারাও হয়ে উঠতে পারে "truthful, as generous and as brave as the Briton." এক কথায় 'ঢাকা নিউজ' স্থানীয়দের জন্য প্রতিকূল পরিবেশ অনুকূলে আনায় সচেষ্ট থাকবে। দ্বিতীয়ত, নীলকরদের সহায়তা করবে। নীলকরদের যেভাবে চিত্রিত করা হচ্ছে 'ঢাকা নিউজ' তার সঙ্গে একমত নয়।

১০. কার্যত কিন্তু 'ঢাকা নিউজ' দ্বিতীয় উদ্দেশ্যে যতটা না গুরুত্বারোপ করেছিল ততটা অন্যগুলোতে পিছিয়ে। বরং দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি সামনে রেখে তারা কম্পানি, প্রশাসন ও মিশনারিদের কঠোর সমালোচনা করেছিল। 'ঢাকা নিউজ'র সংবাদ পরিবেশন সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন সোম প্রকাশ-- ''ঢাকা নিউজ সম্পাদক বলেন, চা-করদিগের অত্যাচারের বিষয় লইয়া এ ক্ষেত্রে সংবাদপত্রে যে আন্দোলন হইতেছে সে সমুদায় মিথ্যা, চা-করেরা অত্যাচার করে না। নীলকরদিগকে নষ্ট করিয়া এতদ্দেশীয় সংবাদপত্রের সম্পাদক ও তাঁহাদিগকে সংবাদদাতা চা-করদিগের সর্বস্বান্ত করিবার চেষ্টায় আছেন। আমাদিগের প্রার্থনা এই চা-করদিগের অত্যাচার বিত্তান্ত মিথ্যাই হোক। কিন্তু আমরা যে প্রমাণ পাইতেছি তাহাতে চা-করেরা নীলকরদিগের 'গাঁর ভাই'। তাহা বলিয়া বিলক্ষণ জানা হইয়াছে।"

১১. এ কারণে 'ঢাকা নিউজ'কে 'প্ল্যান্টার্স জার্নাল' বা 'প্রবর্তক পত্রিকা' হিসেবেও উল্লেখ করা হতো। দেশীয়দের পত্রিকাটি নিম্নস্তরের বলে মনে করত এবং এদের নানাভাবে গালাগাল করতেও দ্বিধাবোধ করেনি তারা। সম্পাদক আলেকজান্ডার ফর্বস ছিলেন স্কটল্যান্ডের অধিবাসী। নীলকর জি পি ওয়াইজের সহকারী হিসেবে ১৮৪৪ সালে এসেছিলেন ঢাকায়। খুব শীঘ্রই নিজের স্থান করে নিয়েছিলেন ইউরোপীয় ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের কাছে। 'ঢাকা নিউজ' সম্পাদনা করেছিলেন দু'বছর এবং তারপর ঢাকা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন কলকাতায়। সেখানে ইংরেজি পত্রিকা 'হরকরা'র সম্পাদক ছিলেন কিছুদিন। তার সম্পর্কে সোম প্রকাশ লিখেন-- "ফর্ব্বস, প্রধানতঃ দ্বারকানাথ ঠাকুরের রেসমের কুঠিতে, পরে আলী মিয়ার জমিদারীর অধ্যক্ষ হন। তিনি এককালে নীলকুঠির অধ্যক্ষ, ঢাকা ব্যাঙ্কের সেক্রেটারি ও ঢাকা নিউজের সম্পাদকের কার্য সমাধান করেন। ফর্ব্বস উপযুক্ত ব্যক্তি সন্দেহ নাই। কিন্তু তাঁহার স্বভাবটি ভাল নয়।"

১২. উপমহাদেশে উদিত বাঙ্গলায় সাময়িকপত্রের জনক বাঙালি বলা হলেও তথ্যবিভ্রাট রয়ে যায়।১৮১৮ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয় বাংলা ভাষার প্রথম পত্রিকা 'দিকদর্শন'। সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন ইংরেজ মিশনারি জোশুয়া মার্শম্যানের ছেলে জন ক্লার্ক মার্শম্যান। মাসে একবার বের হতো বাংলা ও ইংরেজি অনুবাদ একসঙ্গে (দ্বিভাষিক) প্রকাশিত হতো। বাংলা ভাষার প্রথম ছাপানো সংবাদপত্র যে কোনটি, সে বিষয়ে রয়েছে মিশ্র সংশয়। শ্রীরামপুরের 'সমাচার দর্পণ' এবং গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের 'বেঙ্গল গেজেট' প্রকাশের ব্যবধান ১০-১৫ দিন হলেও 'বেঙ্গল গেজেট' এর প্রকাশকাল আগে বলেই ইঙ্গিত মিলে। যদিও স্থায়িত্বকাল ছিল বছরখানেক। আর 'সমাচার দর্পণ' ছিল সে যুগের বিখ্যাত পত্রিকা। জুলাই ১৮২৬ সাল থেকে সংবাদপত্রটি বাংলার পাশাপাশি ফারসি ও ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হতে থেকে। উত্তর ভারতে দেশীয় ভাষায় কোনো ভারতীয় সংবাদপত্র না থাকায় সেই অঞ্চলের জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হচ্ছিল বলে সরকারের অনুরোধে পত্রিকাটি ফারসি সংস্করণ বের করে ৬ মে ১৮২৬ সালে। নাম দেয়, 'আখবার-ই-শ্রীরামপুর'। ইংরেজি ভাষায় বের হতে থাকে ১৮২৯ সালের জুলাই থেকে। এই পত্রিকার সম্পাদক লর্ড মার্শম্যান হলেও বস্তুত সম্পাদনার ভার ন্যস্ত ছিল এদেশীয় বাঙালি পন্ডিতদের ওপরই। প্রথমাবস্থায় সম্পাদকীয় বিভাগে ছিলেন বিখ্যাত পন্ডিত জয়গোপাল তর্কালঙ্কার। কম্পানি সরকার 'সমাচার দর্পণ' এর প্রতি অনুকূল মনোভাব দেখিয়েছে শুরু থেকেই। সম্পাদক ইংরেজ মিশনারি হওয়া সত্ত্বেও পত্রিকাটি কখনো 'কর্তাভজা' বা সরকারের পোঁ ধরেনি কিংবা মোসাহেবি করেনি। কয়েকটি বিশেষত্বের কথা না তুলে ধরলেই নয়।

১৩. শান্তিপুরের কোনো এক সুতা কাটুনী দু:খিনীর অতিকরুণ চিঠি প্রকাশিত হয়েছিল। আরেকটি এ দেশে ইংরেজ বা ইউরোপিয়ানদের বসবাস ও কৃষিকাজ করার প্রস্তাব সম্পর্কে দেশীয়দের মনোভাব বা ক্ষোভ সম্পর্কিত। 'সমাচার দর্পণ'র জানায়, "দ্বারকানাথ ঠাকুর ও প্রসন্ন কুমার ঠাকুর কলকাতার টাউন হলে এক সভায় প্রস্তাব করেন যে, ইংরেজদের এ দেশে বসতি করার বিরুদ্ধে যে আইন আছে, তা এ দেশের কৃষিকর্ম, শিল্প ইত্যাদির উন্নতির পক্ষে বিশাল প্রিবন্ধক। অচিরেই এই প্রতিবন্ধকতা বা বাধা দূর করে দেয়া হোক।" এই প্রস্তাবের ঘোর বিরোধীতা করে জনৈক পত্রলেখক লিখলেন যে, "যন্ত্রনির্মিত সুতার আমদানি হওয়ায় এ দেশের বহু দিনদরিদ্র নারীর অন্নাভাব হয়েছে, বিলাতের শিল্প কর্মচারীরা বিলাতে থেকেই এ দেশের মানুষের মুখের অন্ন ছিনিয়ে নিচ্ছেন; তারা এ দেশে এসে বসবাস শুরু করলে কি আর রক্ষা আছে!"

১৪. 'সমাচার দর্পণ' এর সংবাদ কণিকা ও তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই ব্রজেন্দ্রনাথের সংবাদপত্রের 'সেকালের কথা' (দু'খন্ড) প্রকাশিত হয় ১৩৩৯ সালে। এই সংকলন প্রকাশিত হওয়ার পরই বাঙালি পাঠক ও গবেষকদের কাছে জলচল হয়ে ওঠে সামাজিক ইতিহাস শব্দটি। ব্রজেন্দ্রনাথ যথার্থই লিখেছিলেন, ''এই সকল পত্রিকা হইতে আবশ্যক তথ্যাগুলি সংকলন ও প্রকাশ করিলে সুগম হইবে দেশের ইতিহাস।" এজন্যই একালে সংবাদপত্রকে বলা হয় চলমান ইতিহাস।

১৫. 'সমাচার দর্পণ' এর আত্মপ্রকাশের প্রস্তুতিটাও মসৃণ ছিল না। বহুদিনের ইচ্ছা থেকে শ্রীরামপুরের মিশনারিরা সরকারের বিরূপ মনোভাবের কারণে জে মার্শম্যানের সম্পাদনায় পরীক্ষামূলকভাবে যে পত্রিকাটি বের করেছিলেন সেটির নাম 'দিকদর্শন'। ইংরেজ রাজপুরুষদের তেমন কোনো আপত্তি না থাকায় 'দিকদর্ন' বন্ধ করে দিয়ে ভিন্ন নামে ও ভিন্ন আকারে বিলাতের প্রাচীনতম সংবাদপত্র 'মিরর অব নিউজ' এর অনুকরণে প্রস্তাবিত সাপ্তাহিকীর নাম স্থির করলেন 'সমাচার দর্পণ'। কিন্তু সংবাদপত্র বের করে রাজপুরুষদের আনুকূল্য হারানোর আশঙ্কায় প্রখ্যাত মিশনারি ও ভাষাবিদ ড. কেরির বাধ সাধার প্রেক্ষাপটে মিশনারিদের দীর্ঘ বৈঠকে আলোচনা শেষে একটি বিশেষ শর্তে প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয় যে, মুদ্রিত প্রথম সংখ্যাটির সঙ্গে একটি অনুবাদসহ পেশ করার পর গভর্নমেন্ট অনুমতি দিলেই প্রকাশিত হবে এবং আপত্তি থাকলে বন্ধ করে দিতে হবে। সে মোতাবেক ১৮১৮ সালের ২৩ মে প্রকাশিত প্রথম সংখ্যা ছাপিয়ে কপি সঙ্গে নিয়ে ড. মর্শম্যান কলকাতায় যান এবং ওই সংখ্যার অনুবাদসহ পত্রিকাটির এক কপি করে ভাইস-প্রেসিডেন্ট মি. এডমন্ট, চিফ সেক্রেটারি ও গভর্নর জেনারেল হেস্টিংসকে পাঠিয়ে দেন। এতে হেস্টিংস নিজের হাতে লেখা চিঠিতে ড. মর্শম্যানকে দেশীয় জনসাধারণের জ্ঞান ও অনুসন্ধিৎসা বাড়ানোর জন্য এই শুভ উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করা শুধু নয়, তিনি সেই বছরেই নিরাপদ মুদ্রণযন্ত্রের ও সাময়িক পত্রিকা পরিচালনা উপযোগী নিয়ম অবধারিত রেখেই তুলে দেন পান্ডুলিপি পরীক্ষার কঠোর নিয়মটিও। লর্ড হেস্টিংসের চিঠি পেয়ে শ্রীরামপুরের মিশনারিরা পরম উৎসাহ পান এবং সাপ্তাহিকীটির প্রকাশনা বজায় রাখেন। উল্লেখ্য, মার্শম্যান পত্রিকাটির সম্পাদক হলেও বস্তুত সম্পাদনার ভার ন্যস্ত ছিল এদেশীয় বাঙালি পন্ডিতদের ওপরই। ফলে ১৮১৮ সালের ২৩ মে (১০ জ্যৈষ্ঠ, ১২২৫ বঙ্গাব্দ) হলো উপমহাদেশের প্রথম বাঙ্গলা সাপ্তাহিকের আত্মপ্রকাশের সোনালি দিন।

১৬. 'সমাচার দর্পণ' ছাড়াও ১৮৪০ সালের আগে প্রকাশিত অনেকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পত্রিকা হলো-- বেঙ্গল গেজেট ১৮১৮ খ্রি.), সম্বাদ কৌমুদী (৪ ডিসেম্বর, ১৮২১ খ্রি.), সমাচার চন্দ্রিকা (৫ মার্চ, ১৮২২ খ্রি.), বঙ্গদূত (১০ মে, ১৮২৯ খ্রি.), সংবাদপ্রভাকর (২৮ জানুয়ারি, ১৮৩১ খ্রি.) সংবাদ পূর্ণচন্দ্রোদয় (১০ জুন, ১৮৩৫ খ্রি.) ও সম্বাদ ভাস্কর (মার্চ, ১৮৩৯ খ্রি.)। পন্ডিত গঙ্গাধর ভট্টাচার্য ইংরেজি ১৮১৮ সালে কলকাতায় প্রকাশ করেন 'বেঙ্গল গেজেট'। 'গেজেট' অর্থ সংবাদ। আদতে পত্রিকাটি আদৌ ইংরেজি ভাষায় লিখিত নয়-- বাংলায়। মিশনারিদের কাছে নানাভাবে ঋণী হলেও গর্বের বিষয় হলো বাঙ্গলা সাময়িকপত্রের জনক একজন বাঙালি।

১৭. কতক গণমাধ্যম ও সাংবাদিক রাজধানী ঢাকার জাতীয় পরিচয়ের আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগছেন। ইঁনাদের genealogy ঘাঁটলে বা pedigree analysis করলে প্রায় সবারই শিকড় বা মফস্বলের ডিএনএ পাওয়া যাওয়ার কথা। বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা কিন্তু রাজধানী থেকে প্রকাশিত হয়নি, এর আশপাশ থেকেও না; হয়েছে মফস্বল থেকে। নাম-- 'রংপুরবার্ত্তাবহ'।

১৮. 'রংপুরবার্ত্তাবহ' নামের পত্রিকাটি আজকের রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় তিনশ কিলোমিটার দূরে রংপুর জেলা থেকে বের হয়েছিল ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে। রংপুরের কুণ্ডী পরগনার জমিদার পরিবারের এক খ্যাতিমান ব্যক্তি কালীচন্দ্র রায় চৌধুরীর ব্যক্তিগত উদ্যোগে এ প্রকাশনার যাত্রা। তিনি রুদ্রদেব চৌধুরীর তৃতীয় পুত্র রাজকিশোর রায় চৌধুরীর কনিষ্ঠপুত্র। তাঁর সম্পর্কেই আগে জেনে না নিলে সংবাদপত্র হালে পানি পাবে না। সে সময় ওই জেলায় নারী শিক্ষার অগ্রদূত ছিলেন তিনি। এ-ই প্রথম যে, নিজ গ্রাম বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে তাতে শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ দেন নিজ পরিবারের শিক্ষিত মেয়েকে এবং একই সঙ্গে ছিলেন রংপুরে নারী শিক্ষা টেক্সট বুক প্রবর্তনের উদ্যোক্তাও। 'বার্ত্তাবহ যন্ত্র' নামের ছাপাখানাটি বসান নিজ গ্রামেই, এটিই বাংলাদেশের প্রথম মুদ্রণযন্ত্র। 'রঙ্গপুরবার্ত্তাবহ' পত্রিকাটি সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরেন রংপুর সাহিত্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শ্রী সুরেন্দ্র চন্দ্র রায় চৌধুরী নিজের এক লেখায়-- "...পরম বিদ্যোৎসাহী কবি কালীচন্দ্র রায় চৌধুরীর যত্নে বার্ত্তাবহের পুষ্টিসাধন হয়। এ পত্রিকার প্রথম সম্পাদক গুরুচরণ শর্ম্মা রায়, পরে সম্পাদকত্ব গ্রহণ করেছিলেন নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন নামে মাত্র সম্পাদক, সম্পাদনার পুরো দায়িত্ব পালন করতেন কুণ্ডী বিদ্যালয়ের পণ্ডিত ভীমলোচন সান্ন্যাল এবং কবি মজিদার কালীচন্দ্র রায় চৌধুরী।"

১৯. 'রংপুরবার্ত্তাবহ' পত্রিকাটি সমকালিক রংপুরের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে এক দর্পণের ভূমিকা পালন করে। এতে প্রকাশ পেতো স্থানীয় অভাব-অভিযোগ এবং স্থানীয় সরকারি কর্মচারীদের দুষ্কর্মসহ সমাজের যতসব অসঙ্গতির সংবাদদাদি। অধিকন্তু জনগণের পক্ষে কথা বলাসহ সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেয়ায় অল্প সময়েই জনপ্রিয় ওঠে এটি। পত্রিকাটির বিষয়বস্তু সম্পর্কে সরকারি নথিতে লেখা হয়েছিল-- 'A weekly paper of news and extracts.' জনগণের পক্ষে কথা বলাসহ এটি সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিত। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই পত্রিকাটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। প্রায় ১০ বছর টিকে ছিল পত্রকাটি। ভারতবর্ষে সিপাহী বিদ্রোহের সময় এটি বন্ধ হয়ে যায়। তবে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তথ্য তালাশে কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত প্রতিষ্ঠিত (১৮১২-৫৯) 'সংবাদ প্রভাকর' পত্রিকায় ১৮৫৭ সালের ১৭ আগস্ট প্রকাশিত এক সংবাদ থেকে জানা যায়-- ''...ছাপাযন্ত্রের স্বাধীনতা নাশক আইন প্রচারিত হইবার 'রংপুরবার্ত্তাবহ' পত্র উঠিয়া যায়।"

২০. উনিশ শতকের (১৮৪৭-১৯১১) একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা 'হিতকরী'। ওই শতকের একজন ব্যতিক্রমী সাহিত্যস্রষ্টা ও লেখক মীর মশাররফ হোসেনের সম্পাদনায় কুমারখালী মথুরানাথ যন্ত্রে মুদ্রিত হয়ে কুষ্টিয়া লাহিনীপাড়া থেকে প্রকাশিত হতো। পত্রিকার উদ্দেশ্য ও নীতি সম্পর্কে জানানো হয়: "সকলের হিতকথা, যাহাতে সর্ব্বসাধারণের হিতের আশা থাকে, সেই সকল কথাই 'হিতকরী'তে প্রকাশ করা হয়। জাতিগত, কি ধর্ম্মগত কোন পক্ষকে লক্ষ্য করিয়া কিছু প্রকাশ হয় না।" আরো বলা হয়: "প্রজাহিতসাধনের লক্ষ্যে সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার আদর্শ নিয়ে 'হিতকরী'র আত্মপ্রকাশ।... দুই দশ টাকা লাভের জন্য 'হিতকরী' প্রকাশ হয় নাই। জীবিকা-নির্বাহের কোন উপায় না পাইয়া এই কুটিল ও জটিলপথ আশ্রয় করা হয় নাই। ন্যায্য বলিব, সত্য প্রকাশ করিব, সত্যাশ্রয়ে থাকিব, সাধারণের হিতকরকার্য্যে অবশ্যই যোগ দিব। আমরা পূর্ব্ব হইতেই বলিয়া আসিতেছি যে, আমরা কোন সম্প্রদায়ভুক্ত নহি, আমরা সকলের। একচোখা নীতি আমাদের নাই। যেখানে অন্যায়, সেইখানেই আমরা; যেখানে অত্যাচার, যেখানে অবিচার সেইখানেই আমাদের কথা। আমরা প্রশংসার প্রত্যাশী নহি। আর্থিক সাহায্যের আশাও রাখি না। সুতরাং আমাদের ভয়ের কোন কারণ নাই...।"(১০ বৈশাখ ১২৯৮)

২১. জাতিবৈর-অসহিষ্ণু সমাজ পরিবেশে বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি ও সম্প্রদায়-সম্প্রীতির মনোভাব নিয়ে ১৫ বৈশাখ ১২ ৯৭ প্রকাশিত হয়েছিল মীর মশাররফ হোসেনের 'হিতকরী'। আর্থিক ক্ষতি, গোষ্ঠীবিদ্বেষ, সামাজিক বিরূপতার মুখেও পত্রিকাটি সামাজিক অবস্থার প্রতিফলন, জনকল্যাণ ও জনমত গঠনেও পালন করে প্রশংসনীয় ভূমিকা। এজন্য অনেক বিরুদ্ধতা ও বিরূপ সমালোচনা সহ্য করে টিকিয়ে রাখতে হয়েছে অস্তিত্ব। কুষ্টিয়ার ছোট আদালতের বিচারক বরদাপ্রসন্ন সোম তাঁর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের খবর প্রকাশিত হওয়ার কারণে প্রকাশ্য আদালতে 'হিতকরী' পত্রিকাকে 'পোঁদ পোঁছা কাগজ' বলে কটূক্তি করেন এবং বিচারালয়েই পত্রিকার সহকারী সম্পাদক উকিল রাইচরণ দাসকে ভর্ৎসনা ও অপমান করেন। শুধু তাই নয়, বিচারক মহোদয় রাইচরণ দাসের বিরুদ্ধে মোকদ্দমাও দায়ের করেন। এরপর ভীতি ও প্রলোভন প্রদর্শন করে 'জজবাবুর স্বপক্ষে লিখিবার জন্য 'হিতকরী'র নিকট গোপন প্রস্তাব হইল সকলই বিফল।" (হিতকরী: ২২ ভাদ্র, ১২৯৮)

২২. উল্টো স্রোতে পড়ে তৃতীয়বর্ষে 'হিতকরী' টাঙ্গাইলে স্থানান্তরিক হয়। পথচলায় গতি না হারিয়ে ওইখানেও পত্রিকায় প্রকাশিত হয় দেলদুয়ার জমিদারবাড়ির কলহ-বিবাদের অনেক ঘরোয়া খবর। মীর মশাররফ তখন দেলদুয়ার এস্টেটের ম্যানেজার। এছাড়া টাঙ্গাইলের কোনো কোনো সরকারি কর্মকর্তাও মীরের প্রতি বিদ্বিষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। এসব কারণে তাই স্বনামে পত্রিকা সম্পাদনা তাঁর পক্ষে নিরাপদ ছিল না বলেই তার বিশ্বস্ত মুসলেমউদ্দীন খাঁকে অর্পণ করেন সম্পাদনার দায়িত্ব। প্রসঙ্গত, 'গ্রামবার্তা প্রকাশিকা' সম্পাদক কুমারখালীর কাঙাল হরিনাথ মজুমদার (১৮৩৩-৯৬ খ্রি.) ও কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-৫৯ খ্রি.) প্রতিষ্ঠিত 'সংবাদপ্রভাকর' পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের উৎসাহ ও তত্ত্বাববধানে মীর মশাররফ হোসেনের সাংবাদিকতার হাতেখড়ি বলে জানা গেলেও 'হিতকরী' প্রকাশের ১৬ বছর আগেই ১৮৪৪ সালে 'আজীজন নেহার' প্রকাশিত হয়।

২৩. একবিংশ শতাব্দীতে যখন আধুনিক সাংবাদিকতা বিজয়পতাকা উড়াচ্ছে প্রিন্ট, অনলাইন, ইলেকট্রনিক থেকে ডিজিটাল মিডিয়া; তখনও কিন্তু সাংবাদিকতা নিয়ে গোটা দেশজুড়েই নানা প্রশ্ন উত্তাপিত হচ্ছে। সাংবাদিকতার নৈতিকতা, সাংবাদিকের পেশাদারি কর্তব্য এবং জাতীয়তাবাদী দায়িত্ব নিয়ে বিতর্কও কম নয়। ক্ষেত্রবিশেষে সাংবাদিকের ভূমিকা কতটা বস্তুনিষ্ঠ, কতটা কায়েমি স্বার্থ পরিচালিত এসব আসছে সামনে। আবার পেশাদারি সাংবাদিকতার চলও এখন গোটা দেশে বেড়েছে। মফস্বলেও সাংবাদিকদের গুরুত্বও চোখে পড়ে পত্রিকাভেদে। এ দেশের গ্রামে গ্রামে বহু নাম না জানা সাংবাদিক আজো সাধ্যমতো গ্রামীণ সাংবাদিকতা করে চলেছেন। সামাজিক আন্দোলনে তাঁদের অবদান ফেলনা নয়, বরং উজ্জ্বল। ইতিহাসসিদ্ধও। তা মানছি কই? শিকড় ছেড়ে শিখরের বড়ত্বে মজে আছি। নিচে তাকালে জাত যাবে না? সেই জাতের মাথা খেয়েই কুর্নিশ করছি বেজাতকে, যাঁদের কাছ থেকে বিখ্যাত ব্যক্তিরাও নিচ্ছেন শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা। তেমনি একজন কাঙাল হরিনাথ। আসল নাম কাঙাল হরিনাথ মজুমদার। যিনি বাংলাদেশ শুধু নয়, ভারতের গ্রামীণ সাংবাদিকতার প্রবাদ পুরুষ এবং সাংবাদিকতার জগতে সম্ভবত প্রথম সফল কান্ডারী। জনকও। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকতায় নৈতিকতার প্রশ্নে 'খালি কলস লড়ে বেশি' বলে উনিশ শতকী বাংলার পীত সাংবাদিকতার আদি ও প্রবাদ পুরুষটির মহিমাকে আমরা 'মুই কি হনুরে' উঁচুশিরে এবং 'একাডেমিক সনদ'র আমফানে উড়িয়ে দিচ্ছি। আর নতুন প্রজন্মের ক'জনইবা জানি তাঁর সম্পাদিত 'গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা' পত্রিকাটি ছিল তৎকালীন গোটা ভারতবর্ষের তমসাচ্ছন্ন গ্রামজীবনের কণ্ঠস্বর।

২৪. কাঙাল হরিনাথের ছিল গরিবী জীবন। স্থানীয় স্কুলের হেডমাস্টার মশাইয়ের দয়ায় কিছুদিন বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। জন্মেছিলেন তৎকালীন পাবনা জেলা বর্তমানে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর কুণ্ডাপাড়া গ্রামে। কুমারখালীতে ছিল অনেক নীলকুঠি। ওই সাহেবদের ওখানে কিছুদিন কাজ করলেও নীল চাষিদের ওপর অত্যাচার-অবিচার দেখে প্রতিবাদী হয়ে সেটা ছেড়ে দিয়ে মনোনিবেশ করেন গ্রামীণ সাংবাদিকতায়। আমৃত্যু করে গেছেন নিষ্ঠার সাথে। আবার শিক্ষানুরাগীও ছিলেন। স্ত্রী-শিক্ষার জন্য একটি পৃথক সংগঠন তৈরি এবং তাঁর বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপ গৃহে একটি বালিকা বিদ্যালয়ও স্থাপন করেছিলেন।

২৫. তৎকালীন বাংলার জাগ্রত বিবেক যখন বিস্মৃতির অন্ধকারে, জুলুম-অত্যাচার, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে লিখে নির্ভীক সাংবাদিকতার পথিকৃৎ হিসেবে ১৮৫৭ সালে কুমারখালীর প্রাচীন জনপদের নিভৃত গ্রাম থেকে তিনি হাতে লিখে প্রথম প্রকাশ করেন মাসিক 'গ্রামবার্তা প্রকাশিকা'। হাজারো বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে পত্রিকাটি প্রায় একযুগ প্রকাশ করেছিলেন। মাসিক থেকে পাক্ষিক এবং পরবর্তীতে ১৮৬৩ সালে সাপ্তাহিক হিসেবে কলকাতার 'গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত' প্রেস থেকে নিয়মিত প্রকাশকালীন থাকাবস্থায়ই পত্রিকাটি ১৮৭৩ সালে সুহৃদ অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়ের বাবা মাথুরাম মৈত্রেয়ের আর্থিক সহায়তায় কুমারখালীতে এমএন প্রেস স্থাপন করে অব্যাহত রাখেন সাড়া জাগানিয়া 'গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা'র প্রকাশনা। তাঁর সংবাদপত্রে তিনি একদিকে যেমন মেয়েদের ইংরেজি শিক্ষা প্রসারের দাবি দিনের পর দিন তুলেছেন, অন্যদিকে জমিদার, ইংরেজ নীলকর, জমিদার, মহাজন, পুলিশ ও পঞ্চায়েতপ্রধানসহ শোষক শ্রেণির জুলুম, অত্যাচার-অবিচার ও বাড়াবাড়ির কাহিনি সাহস ও নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁর পত্রিকায় প্রচার করে গিয়েছের আপসহীন লড়াকু মসিযোদ্ধা হয়ে। হরিনাথ স্বয়ং শিলাইদহের ঠাকুর-জমিদারদের অত্যাচার ও নিপীড়নের সাক্ষী ছিলেন। তাঁর পত্রিকায় তিনি তা দ্বিধাহীনচিত্তে ঠাকুরবাড়ির প্রজাবিরোধী অত্যাচারী ভূমিকার তথ্যভিত্তিক রিপোর্ট প্রকাশ করে সাড়া ফেলে ছিলেন।

২৬. কাঙাল হরিনাথের পথচলা বাস্তব তথ্যের সঙ্গে মেলানো যেতে পারে, যাকে আমরা সাংবাদিকরা বলে থাকি 'ক্রস-চেক'। হরিনাথ নিজেই গ্রাম-গঞ্জ ঘুরে সংবাদ সংগ্রহ করতেন এবং পাঠকদের হাতে তুলে দিতেন একটি বলিষ্ঠ পত্রিকা। সাহসী এই কলমসৈনিক ১৮৭২ সালে দু:খী মানুষের পক্ষে কালাকানুনের বিরুদ্ধে পত্রিকার মাধ্যমে তির্যক প্রতিবাদ জানান। গ্রামে বসবাস করেও উনিশ শতকের বুদ্ধিজীবী কাঙাল হরিনাথ ১৮৬৩ সালে নীলকর সাহেব অর্থাৎ শিলাইদহের জোড়াসাঁকোর ঠাকুর জমিদারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে কৃষকদের পক্ষে প্রবন্ধ লিখে তোলপাড় সৃষ্টি করার কারণে ঠাকুর জমিদার হরিনাথকে খুন করার জন্য ভাড়াটে গুন্ডা পাঠান। তা প্রতিরোধে হরিনাথকে রক্ষা করেন সতীর্থ বাউল সাধক লালন ফকির নিজেই তার দলবল দিয়ে। এছাড়া প্রশাসনযন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গের ভুল-বিচ্যুতি ও নীতি-আদর্শ ঙ্খলনের কঠোর সমালোচনাও করতেন।কায়েমী স্বার্থের সঙ্গে সেবা পরায়নতার সম্পর্ক বজায় রাখতে না পারায় জটিলতর ও অসমাধানের রূপ নিতো। ফলে প্রভূত ক্ষতি স্বীকার করেই পত্রিকা চালাতেন। একবার পাবনা জেলার তদানীন্তন ইংরেজ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মফস্বল পরিদর্শনে এলে এক দরিদ্র বিধ্ববার একটি দুগ্ধবতী গাভীর প্রতি লোভ হয় এবং জবরদস্তি করে নিয়ে যায়। এ সংবাদ সাংবাদিক-সম্পাদক কাঙাল হরিনাথের কর্ণগোচর হলে তা যাচাইয়ের ভিত্তিতে তিনি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের এই অনৈতিক ও গর্হিত অন্যায় কাজের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে ফলাওভাবে খবর প্রকাশ করেন 'গরুচোর ম্যাজিস্ট্রেট' শিরোনামে। সংবাদটি রাষ্ট্র হলে সংক্ষুব্ধ ম্যাজিস্ট্রেট হরিনাথের প্রতি অতিশয় রুষ্ট হন এবং চেষ্টা করেন ওই সাংবাদিককে সময়োচিত শায়েস্তা করার। কিন্তু কাঙাল হরিনাথের সত্যসেবার অসামান্য চারিত্রিক দৃঢ়তার কারণে ম্যাজিস্ট্রেটের পক্ষে হরিনাথের সত্যসন্ধিৎসু অভিযাত্রাকে ঠেকাতে পারেননি। বরং পরবর্তীকালে সত্যনিষ্ঠ স্বাধীন মত প্রকাশের নির্ভীকতার জন্য উক্ত ম্যাজিস্ট্রেটের ভূয়সী প্রশংসা করে গ্রামীণ সাংবাদিক হরিনাথকে লিখেন-- "এডিটর আমি তোমাকে ভয় করি না বটে; কিন্তু তোমার নির্ভীক সত্য লেখনীর জন্য আমি অনেক কুকর্ম ত্যাগে বাধ্য হয়েছি।"

২৭. কৃষক-প্রজা-রায়ত-শ্রমজীবী এবং মধ্যবিত্ত মানুষের সবচেয়ে বেশি আনুকূল্য পেয়েছিল তাঁর এই পত্রিকা। স্বদেশ শিল্প-বাণিজ্য বিকাশের পরোধাও তিনি। তিনি যে জ্ঞানের দ্বীপ জেলেছিলেন তা ছিল অনন্য এক দৃষ্টান্ত। গ্রামীণ অসহায় মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছিল 'গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা' পত্রিকাটি।

☞হিকির 'বেঙ্গল গেজেট': উপমহাদেশের প্রথম পত্রিকা
২৮. আজকের বড় বড়, নামি-দামি পত্রিকার দীর্ঘ যাত্রাপথের শুরুটা হয়েছিল একটি পত্রিকার সাহসী আবির্ভাব থেকে। আর সেই পত্রিকার নাম ছিল 'বেঙ্গল গেজেট'। জেমস অগাস্টাস হিকি নামক এক বিদেশির (জন্মসূত্রে আইরিশ) একক প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা এই পত্রিকা ছিল উপমহাদেশের বুকে প্রকাশিত প্রথম পত্রিকা। তবে ভারতবর্ষের পত্রিকার জনক হতে পারতেন ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির সাবেক চাকুরে উইলিয়াম বোল্টস। কিন্তু কপালের ফেরে সেই তকমাটা লাগে জেমস অগাস্টাস হিকির নামের সঙ্গেই। তাঁর দেখানো পথ ধরেই পরে ভারতবর্ষে নানা রকম পত্রিকা চালু হয়।

২৯. মৌর্য যুগে রাজকর্মচারীদের মধ্যে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত একটি শ্রেণি ছিল, যাদের যাদের বলা হতো প্রতিবেদক। সারা রাজ্য ঘুরে রাজ্যের বিভিন্ন খোঁজখবর নিয়ে আসাই ছিল তাদের কাজ। এই চর্চাটিকে ইতিহাসবিদদের অনেকেই আজকের যুগের সাংবাদিকতার সমতুল্য মনে করছেন। এ হিসেবে সাংবাদিকতা বাংলা ভূখন্ডে চর্চিত হয়েছে খ্রিস্টের জন্মেরও আগে। তবে সাংবাদিকতার ব্যাকরণ মানলে বলতে হবে, সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশে সংবাদপত্রের জন্ম হয়েছে ব্রিটিশ শাসনামলে। ওই সময়ে বাংলা ভূখন্ডে সংবাদপত্র প্রকাশের সঙ্গে যাঁর কথা জানা যায় তিনি হলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির কর্মচারী উইলিয়াম বোল্টস। ১৮৬৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাঁরই স্বাক্ষর করা গণনোটিশ থেকে বুঝা যায় তিনি ছিলেন প্রথম উদ্যোক্তা। পত্রিকা প্রকাশ করার আগেই কম্পানির কর্তৃপক্ষ বোল্টসকে মাদ্রাজ ডেকে নিয়ে সেখান থেকেই জাহাজে করে পাঠিয়ে দেয়া হয় নিজ দেশে।
কারণ, বোল্টস কম্পানির ভেতরের খবরাখবর জানতেন।

৩০. হিকি ভারতবর্ষের সার্বিক পরিস্থিতির সাথে ইংল্যান্ডের পরিস্থিতির তুলনা করতে ১৭৮০ সালের ২৯ জানুয়ারি প্রকাশ করেন 'বেঙ্গল গেজেট', যা 'হিকির গেজেট' নামে অধিক পরিচিত। এই পত্রিকার একমাত্র সাংবাদিক, সম্পাদক ও কবির দায়িত্বে ছিলেন হিকি নিজেই। পত্রিকাটির স্লোগান ছিল-- "A Weekly Political and Commercial Paper, Open to all Parties, but influenced by none." অর্থাৎ 'এটি একটি সাপ্তাহিক রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক পত্রিকা, সবার জন্য উম্মুক্ত, কিন্তু কারো দ্বারা প্রভাবিত নয়।'

৩১. যখন উপমহাদেশে 'বেঙ্গল গেজেট' এর নজরদারি শুরু হলো, তখন অনেকেরই মুখোশ খুলে যাবার ভয়ে সংযত থাকা শুরু করেন। সাধারণ মানুষও অনুভব করতে পারলো পত্রিকার কী অসাধারণ শক্তি! হিকির দেখানোর পথ ধরেই পরে ভারতবর্ষে নানান পত্রিকা চালু হয়। হিকির লেখার হাত ছিল চমৎকার। ধরনও। শুধু পত্রিকা বের করা দু'চারটা পাড়ার খবর ছেপে সন্তুষ্ট থাকার লোক ছিলেন না তিনি। নেতৃস্থানীয় বিদেশিদের বিভিন্ন অপকর্মের কথা তুলে ধরেন তাঁর দু'পাতার রাজ্যে। কিন্তু তিনি কোথাও ইঁনাদের নাম সরাসরি ব্যবহার করতেন না। সংবাদের ব্যক্তিবর্গের পরিচয় তিনি তার দেয়া ছদ্মনামের আড়ালে লুকিয়ে রাখতেন। 'চোরের মন পুলিশ পুলিশ' বলেই নড়েচড়ে উঠল শাসক সমাজ। কারণ, তার লেখার ধরন এবং তথ্যসম্ভার এতটাই শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ ছিল যে, তা অবিচার-অত্যাচারীদের কলিজায় লাগত। হিকি বেশ দক্ষভাবে গল্পের একদম গভীরে ঢুকে যেতেন তদন্ত করতে করতে। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অনিয়ম এবং দুর্নীতির খবর ছাড়াও গণমানুষের কথা ছাপানো হতো তার পত্রিকায়। ভারতীয়দের সাথে অন্যান্য দেশের নাগরিকদের জীবনধারার তুলনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশিত হতো বেঙ্গল গেজেটে। সামরিক, বেসামরিক পদে কর্মরতদের আত্মত্যাগের কথা তুলে ধরে হিকি পরোক্ষভাবে এক জাগরণের ডাক দিয়েছিলেন। হিকি এবং বেঙ্গল গেজেটের আতশীকাঁচেের নিচে ধরা পড়তে হলো স্বয়ং তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে ঘুষ প্রধানের মাধ্যমে তাঁর পছন্দের রায় দিতে বাধ্য করেছিলেন তিনি। বেঙ্গল গেজেটে হেস্টিংস এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সাথে ইঁনার দুর্নীতির কথা বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করা হয়। এমনকী অতিরিক্ত কর আরোপের ফলে জনগণের ভোগান্তির জন্য সরাসরি ইঁনাকে দায়ি করা হয়। বেঙ্গল গেজেটের হুংকার ভারতবর্ষ ছাপিয়ে ইংল্যান্ডে গিয়ে পৌঁছায়। সেখানে কর্তৃপক্ষ ওয়ারেন হেস্টিংসের কাছে ত্বরিত জবাবদিহিতা চেয়ে পত্র পাঠান। সাথে সাথে শুরু হয় তদন্ত। হিকির সেদিনের প্রতিবেদন ভারতবর্ষ থেকে হেস্টিংস অধ্যায়ের যবনিকাপাত ঘটিয়েছিল। তইঁনাকে পদচ্যুত করে ফিরিয়ে নেয়া হয় ইংল্যান্ডে। পরবর্তীতে হিকির মিথ্যা মামলা খেয়ে জেলে গিয়েও না দমে ওইখানে বসেই পত্রিকা ছাপাতে লাগলেন। এক পর্যায়ে এক ফরমানে হিকির স্বপ্নের প্রকল্প ও জনগণের তৃতীয়চোখ সংবাদপত্রের প্রকাশনা বন্ধ করে দিয়ে সব সিলগালা করে দেয়া হলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি। সরকার দু'হাতে গলা টিপে তার বিপ্লবকে হত্যা শুধু নয়, তাঁকেও দেশত্যাগে বাধ্য করলে চীনের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমানো জাহাজে মৃত্যুবরণ করেন। হাজার হাজার দুর্নীতিবাজ ইংরেজের ছিল ক্ষমতা, কিন্তু হিকির ছিল দু'পাতার একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। হিকি নেই, তাই বলে বিপ্লব থেমে যায়নি। ভাবতে অবাক লাগে, অষ্টাদশ শতকে হিকি যে সাহস দেখিয়েছিলেন তাঁর পত্রিকার মাধ্যমে, সেটি আধুনিক যুগের সংবাদপত্রে বিরল বটে। আধুনিক সংবাদপত্রের উৎস খুঁজতে হলে আমাদের চলে যেতে হবে খ্রিস্টপূর্ব ৪৯ সালে। সে দীর্ঘ আলোচনা।

☞ 'হাওরবাংলা প্রতিদিন.কম': সামনে চ্যালেঞ্জ
৩২. 'হাওরবাংলা প্রতিদিন.কম' এমনি সত্যের সন্ধিক্ষণে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে যখন 'দৈনিক সংবাদ'র হাওর জেলা সুনামগঞ্জের তাহিরপুর প্রতিনিধি কামাল হোসেনকে গাছে বেঁধে পিটিয়ে আধমরা করে ফেলা হয়েছে যেন কলম ধরতে না পারে। স্বার্থান্বষী মহলটি কাঁচাটাকা হাতাতে তাহিরপুরের ঐতিবাহী জাদুকাটা নদীর পাড় কেটে জনপদ ও কৃষি জমি উজাড় এবং পরিবেশ বিনষ্ট করছিল বলে পেশাগত দায়িত্ব পালনে ছবি তুলতে গেলে সাংবাদিক কামাল কুচক্রীদের টার্গেট হন। ভীষণ পরিতাপের বিষয় যে, বর্তমান গণতান্ত্রিক পরিবেশেও সাংবাদিকরা বসবাস করতে হচ্ছে পেশাগত নিদারুণ ঝুঁকির মধ্যে। ক্রমশ বিপজ্জনক পেশায় পরিণত হয়ে সাংবাদিকরা পরিগণিত হচ্ছে মজলুম সম্প্রদায় হিসেবে। এ ঝুঁকি দিন বদলের হাওয়ায় আঞ্চলিক বা মফস্বল সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে অধিক প্রকট। কেননা তারা আরো কঠিন বাস্তবতাকে আলিঙ্গন করে কর্তব্যে নিষ্ঠাবান থেকে বহুবিধ প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে এবং এলাকার স্থায়ী নিজ ও পরিবারের বিধ্বংসী প্রতিপক্ষ তথা শত্রু তৈরি করে সংবাদ পাঠায় কেন্দ্রীয় পর্যায়ে। অথচ বাকস্বাধীনতা স্বাধীন দেশের মানুষের অর্জিত অধিকার। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা, স্বার্থরক্ষা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সংগঠন বা সংস্থা কাজ করলেও ঢাকার বাইরে তাদের দৃষ্টি নেই। যদিও আইজেএফ ও সিপিজে নামক সংস্থার শাখা রয়েছে। এখন সময় এসেছে ওইসব সংগঠনগুলোর প্রত্যন্ত হাওরাঞ্চলে কাজ করার।

৩৩. আমাদের স্বাধীন দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রত্যাশিত। সংবাদপত্রের সাথে অনেকেই সংশ্লিষ্ট। সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যমের এক বা একাধিক মালিক থাকেন। থাকেন সাংবাদিকবৃন্দ ও কর্মীবাহিনী। থাকেন লেখক। বিজ্ঞাপনকর্মী। পাঠক। তাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব বৃত্তের স্বাধীনতা থাকতে হবে সংবাদপত্রকে ঘিরেই। রাষ্ট্রের রয়েছে তিনটি স্তম্ভ-- ১. জাতীয় সংসদ, ২. নির্বাহী বা শাসন বিভাগ এবং ৩. বিচার বিভাগ। এই তিনটি স্তম্ভের সঙ্গে 'সংবাদমাধ্যম বা গণমাধ্যম' অপরিহার্যভাবে যুক্ত হয়ে চারটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে রাষ্ট্র। বিপদগ্রস্ত মানুষজন বিপদ থেকে প্রতিকার চাইতে সাংবাদিককেই খুঁজে। গ্রাম, শহর, বন্দরের যেকোনো বয়সের মানুষ গণমাধ্যমকেই দেখে তাদের ভরসা হিসেবে। বস্তুত, দেশের মানুষজনের নাগরিক অধিকার রক্ষায় প্রায় 'অকার্যকর' জাতীয় সংসদের চাইতে অনেক বেশি কার্যকর স্বাধীন গণমাধ্যম।

৩৪. গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তি জনমত। এই জনমত প্রকাশের অবাধ অধিকার থাকতে হবে। যেন জনগণ ইচ্ছামত সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে মতামত প্রকাশ করতে পারে। এতে কেউ বাধা দিতে পারে না। কোনো ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান কিংবা সরকার ভুল করলে সাংবাদিকরা সত্য বিষয়টি লিখনীর মাধ্যমে তুলে ধরেন। এভাবে জনমত তৈরিতে ভূমিকা রাখে সংবাদপত্র। এটি সংবাদপত্রের অধিকার এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা। সাংবাদিকরাও আইনের ঊর্ধ্বে না; না অন্য কেউ। জনগণেরও মৌলিক অধিকার রয়েছে তথ্য জানার। সত্যে সমাদৃত এ তথ্যসমুদ্র বাতিঘরের প্রয়োজন মেটায় সংবাদমাধ্যম। সাংবাদিকরা জনগণের বাইরে নন। সংবাদমাধ্যম ও সংবাদিকের দায়িত্ব ও কাজ হচ্ছে প্রতিকারের মানসে যতসব অসঙ্গতির তথ্যচিত্র রাষ্ট্রযন্ত্র, সরকার বা সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ তথা যেকোন মূল্যে তথ্য জনসম্মুখে তুলে ধরা। সাংবাদিকের কলম মুক্ত হলে সমাজ ও রাষ্ট্র উপকৃত হয়।

৩৫. সাংবাদিকতা মানে হচ্ছে যা সত্য, যা কঠিন, যা মানুষের জানা দরকার; তা বস্তুনিষ্ঠভাবে তীর্যকভাবে তুলে ধরা। এতে কোনটির সমাধান হয়, কোনটি চলে সমাধানের পথ ধরে। বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যম জগতে সমাদৃত নীতিটি হচ্ছ--"Facts are Sacred, Commands are free, News is based on fact, fiction is not news." অর্থাৎ ''ঘটনাগুলো পবিত্র, আদেশগুলো নিখরচায়, সংবাদ তৈরি হয় সত্যের ভিত্তিতে, কল্পকাহিনী কোনো সংবাদ নয়।" বোতল অর্ধেক ভরা কিংবা বোতল অর্ধেক খালি বলা গেলেও, নেই দোসরা বলার 'সুযোগ গেম'। মানে, সত্য-মিথ্যার লাবড়া হবে সাংবাদিকতার গায়ে হলুদ।

৩৬. মরা সাপ পেটানো যেমন সাংবাদিকের কাজ নয়, তেমনি 'সবার আগে সব খবর' স্লোগান চাণক্যে বাহবা কুড়িয়ে পাঠকের তালুতে বসাও কাম্য নয়। সেহেতু-- 'থাম, শান্ত হও; জেনে-বুঝে খবর ছড়াও।' বরং আসন গাড়তে হবে পাঠকের আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গাটিতে। সুতরাং-- 'মনেরে আজ কহ যে, /ভালো-মন্দ যাচাই আসুক সত্যরে লও সহজে।'

☞ পাদটীকা:
"কাঙালের 'গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা' পত্রিকা থেকে আমি আমার সাংবাদিক জীবনযাপনের অনুপ্রেরণা পেয়ে থাকি।"
৩৭. ওপার বাংলার প্রভাবশালী 'দেশ' পত্রিকার প্রাক্তন প্রখ্যাত সম্পাদক প্রথিতযশা সাংবাদিক বঙ্কিমচন্দ্র সেন গ্রামীণ বা মফস্বলীয় সাংবাদিকতাকে এভাবেই মর্যাদার চূড়ায় স্থান দিয়েছেন। তোমাতেও হোক 'হাওরবাংলা প্রতিদিন.কম'।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
সহযোগী সম্পাদক, আজকের সূর্যোদয়, ঢাকা।
[email protected]
১৩/৪/২০২১