বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪

| অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

পরীক্ষামূলক

হাওর বাংলা প্রতিদিন.কম || HaorBangla Protidin.com

মাছে ভাতে পাঁচ টাকা

কামরুল ইসলাম

প্রকাশিত: ০৭:৪৪, ২৫ এপ্রিল ২০২১

আপডেট: ০৭:৪৮, ২৫ এপ্রিল ২০২১

মাছে ভাতে পাঁচ টাকা

গত শতাব্দীর আশির দশকে কিছুটা বোহেমিয়ান তাড়না থেকে ব্র‍্যাক এর প্রথম প্রকল্প শাল্লায় (শাল্লা,বানিয়াচং ও দিরাই উপজেলা নিয়ে গঠিত) যোগদান করি। ঢাকা থেকে ট্রেনে শ্রীমঙ্গল স্টেশন, ভোরে শেরপুর।শেরপুরে তখন সেতু নির্মিত হয়নি।সকালে হোটেলের লোকজন হাঁক দিচ্ছে "মাছে ভাতে পাঁচ টাকা"।বড় একটি পাবদা মাছ ও দেড় প্লেট ভাত খেয়ে নিয়ে সকাল দশটায় প্রকল্প হেড কোয়ার্টারস (মার্কুলীর) উদ্দেশ্যে লঞ্চে চেপে বসলাম।লঞ্চ হাওরের বুক চিড়ে নদীর সামান্য বাঁক ঘুরে এগিয়ে চলছে। বিকেল ৪ টা নাগাদ (মার্কুলী) পৌঁছালাম।

পরদিন সকালে (মার্কুলী) থেকে পদব্রজে ১৭ মাইল দূরে ব্র‍্যাক আগারগাঁও অফিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম, ওটা হলো আমার কর্মস্থল। আমার সাথে আমার বেডিংসহ একজন মুটে আছেন এবং তিনিই আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলছেন। শুকনো মৌসুম তাই পায়ে হাঁটা ছাড়া কোন বাহনও নেই।দুপুরে ব্র‍্যাক আনন্দপুর অফিসে যাত্রাবিরতি ও দুপুরের খাবার গ্রহণ। বিরতি শেষে আবার হাঁটা শুরু করে বিকাল পাঁচটায় আগারগাঁও অফিসের উপকন্ঠে (সাওতা) নদীর তীরে এসে পারাপারের জন্য থামলাম।(সাওতা) নদীর তীরে বসে দেখি পানিতে মাছের খেলা। বড় বড় চিতল,রুই,বোয়াল পানিতে ঢেউ তুলছে।নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না।আমার পৈতৃক ভিটাও প্লাবনভূমি অঞ্চলে।মাছের প্রাচুর্য আমার এলাকায়ও আছে তবে মনে হলো হাওড়ের মাছের প্রাচুর্য চাঁদপুরকেও ছাড়িয়ে গেছে।

লক্ষ্য করলাম খাবারে তেমন বৈচিত্র‍্য নেই।মাছ ও ধানের প্রাচুর্যের কারণেএই দুটি পদই প্রধান। সবজি,ফল ও দুধের তেমন প্রচলন  দেখলাম না। তাই বাধ্য হয়ে প্রতি শনিবার নেত্রকোনার (লিপসা) বাজারে নৌকা পাঠিয়ে এক সপ্তাহের সবজি আনিয়ে নিতাম।গেরস্থের বাড়িতে দুধ থাকলেও বিক্রি কর‍তে চাইতো না কারণ দুধ বিক্রি করা ভালো চোখে দেখা হতো না। ধান কাটা মাড়াই শেষে গোষ্ঠী প্রধানগণ গরু জবাই করে গ্রামবাসীকে খাওয়াতেন।আমিও আমন্ত্রিত হয়ে খোলা আকাশে কলাপাতার পাত্রে গ্রামবাসীর সাথে মাংস ও ভাত খেয়েছি।

নিস্তরঙ্গ জীবনে প্লাবন কালে হাতে অফুরন্ত সময় থাকে,সে সময় কম আয়ের মানুষ মাছ ধরে। বিনোদন বলতে সনাতন ধর্ম অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে হারমোনিয়াম, তবলা, খোল-করতাল ছিল এবং তারা ধামাইল, ভজন, রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতেন। নিশীথ রাতে ধামাইল গানের সুরে মাঝে মধ্যে আমার ঘুম ভেঙ্গে যেতো। গাঁয়ের নারীদের দেখেছি সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে সকালবেলা সকল কাজ থেকে আধা ঘন্টার বিরতি নিয়ে সিলেট বেতার থেকে প্রচারিত ধামাইল শুনতেন। সিলেটের আঞ্চলিক গানের দুই বোন শুক্লা দে ও স্বপ্না দে ছিলেন প্রধান দুই শিল্পী। আমিও তাদের কন্ঠে গান শোনার অপেক্ষায় থাকতাম।

সুনামগঞ্জের মানুষ এখন সেই দুই শিল্পীকে চেনেন না। তারাও জীবিকার তাগিদে সঙ্গীত চর্চা ছেড়ে দিয়েছেন। ২৫ বছর পর আমি সুনামগঞ্জ শহরে এই দুই শিল্পীর খোঁজ করেছিলাম। স্বপ্না দে কৃষিব্যাংক সুনামগঞ্জ শাখায় চাকরি করছেন। তার সাথে দেখা করলাম। তার কাছ থেকেই জানতে পারলাম শুক্লা দে ডাকবিভাগে ঢাকায় চাকরি করছেন।

আর্থিক লেনদেন:
আমরা জানি যে মুদ্রা প্রচলনের আগে মানুষ বিনিময় প্রথার (Bartar) মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন করতো। হাওরে তখনো তার রেশ ছিলো। বৈশাখে ধান কাটার পর বাণিজ্যিক তৎপরতা বেড়ে যেত। বিক্রমপুরসহ অন্যান্য জেলা থেকে মাটির পাতিল, জিলাপী, কাপড়-চোপড়, প্রসাধনীসহ বেপারীরা হাওরে এহাটি থেকে ওহাটি ফেরি করে বেড়াতো। ধানের বিনিময়ে বেচাকেনা চলতো। সংসারের যাবতীয় খরচ ধান বিক্রির টাকায় পরিশোধ করা হতো। তাই ধান হলো হাওরের "Life, culture and economy ". অতি সাধারণ পরিবারেও ১০০-২০০ মণ ধান পেতো। তবে মাড়াইয়ের কিছুদিনের মধ্যেই ধানের গোলা খালি হয়ে যেতো। বছরের বাকি সময়টা চলতো ধার কর্জ করে। মহাজনী ঋণ খুবই শোষণমূলক ছিল। চৈত্র মাসে এক মণ ধান কর্জ নিয়ে এক মাসের ব্যবধানে বৈশাখে ২ মণ ধান ফেরত দিতে হতো।

শুধু ধান নির্ভরতা নয়:
জলমহল ও বিলগুলো হাওরের অন্যতম প্রধান সম্পদ। এখানকার মাছের ভাগ সাধারণ মানুষ পায়না। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংযোগ আছে এমন প্রভাবশালীরা এই সম্পদ ভোগ করছে। হাওরের মানুষের আর্থিক সংকট সমাধানে মৎস্য সম্পদের উপর তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বর্তমান ইজারা প্রথা বাতিল করতে হবে।

হাওরে অভিবাসন:
কয়েকটি হাওরের ইতিহাস থেকে জানা গেলো মৃত পূর্বপূরুষরা ধান ও মাছের টানে বৃহত্তর ময়মনসিংহ, ঢাকা ও কুমিল্লা জিলাসমুহ থেকে এসে হাওরের এই নিম্নভূমিতে প্রধানত নদীর উচু তীরে মাটি ভরাট করে ফ্লাড-লেভেলের অধিক উচ্চতায় বসতী স্থাপন করেন। গভীর হাওরের প্রায় ৮০% অধিবাসীদের পূর্বপূরুষরা ভিন্ন জেলার এবং ২০% ভাগ নিজ জেলার উঁচু ভুূমি থেকে ১৫০ থেকে ২০০ বছর পূর্বে বর্তমান আবাস হলে অভিবাসিত হয়েছেন। তবে অনেকে বলছেন যে, হাওরে এসে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। বরং পরিবারের যারা অভিবাসী হননি, তারা তুলনামূলকভাবে অনেক কম জমি নিয়ে অভিবাসীদের থেকে ভালো আছেন।

কেমন হতে পারে হাওরের কাঙ্ক্ষিত জীবন:
হাওরে অবশ্যই দেশের বসবাসের 'অযোগ্য ও (পুঁতিগন্ধময়) শহুরে স্বপ্ন' রপ্তানি করা যাবেনা। 'উন্নয়ন' যেন হাওরে প্রবেশ করতে না পারে। আর ভোগবাদের প্রসার ঠেকাতে হবে, প্রক্রিয়াজাত খাবার, প্রাইভেট কার, আবুরা সড়ক, ফাস্টফুড ইত্যাদি। সেখানে নোংরা উৎস থেকে (কয়লা, ফসিল ফুয়েল) উৎপাদিত বিদ্যুৎ যাবেনা। তাহলে, হাওরে যোগাযোগ, কর্মসসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, বিনোদন কেমন হবে? পরিচ্ছন্ন হবে, বর্ষায় সৌরবিদ্যুৎ চালিত নৌকা এবং শুকনা মৌসুমে ডুবন্ত সড়কে সৌরবিদুৎ চালিত হালকা যানবাহন। থাকবে সৌরবিদ্যুৎ চালিত ধান, ডাল, তেলবীজ ভাঙ্গানো কল, হাসপাতাল, ক্লিনিক, দোকানপাট, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প, ঘরবাড়ি সৌরবিদ্যুতে চালিত ও আলোকিত হবে। সৌরবিদ্যুত অনেক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। মরমী সাধক রাধারমণ দত্ত, হাছন রাজা, শাহ আবদুল করিম ও নাম না জানা অনেক মরমী গায়ক এর গান মানুষের মনের খোরাক যোগাবে।

হাওরের মানুষ দেশের বাকি  অংশের মানুষকে দেখিয়ে দিতে পারে কীভাবে প্রাণ-প্রকৃতির ক্ষতি না করে উন্নত জীবন যাপন করা যায়। মানসিক শান্তিসহ মানসম্পন্ন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান নিয়ে তারা সুখে থাকতে পারেন।
 // //
★লেখক: কামরুল ইসলাম, একজন
বেসরকারি উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ,  ব্রাকের সাবেক কর্মকর্তা এবং সুনামগঞ্জ জেলার হাওর এলাকায় ব্রাকের অনেক সফল প্রকল্প বাস্তবায়নকারী।