[এক]
ছোট্ট বেলা থেকেই গানের প্রতি ছিল এক গভীর অনুরাগ। মা'র মুখে বহুবার শুনেছি এগল্প। আমি নাকি দুধ খেতে চাইতাম না, যতক্ষণ পর্যন্ত মা আমাকে গান গেয়ে না ডাকতেন। "খোকন খোকন করে মা , খোকন রে তুই ঘরে আয়......." তখনি আমি ছুটে এসে দুধ খেতাম। মা আমাকে খোকন বলে ডাকতেন। সে কথা মনে পড়ে না আর। শুধু ভাবনায় খুঁজে পাই , ছিপছিপে গড়নের এক তরুণী সূর্যের রঙ থেকে ধার করা হলুদাভ শাড়িতে নিজেকে জড়িয়ে পরম মমতায় আমায় গান গেয়ে ডাকছে। আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতাম হয়তো। কী অপূর্ব সুন্দরী এক নারী। কাজল পরা গভীর কালো চোখ দুটিতে উপচে পড়া খুশির ঝিলিক , খোপায় তখন ঝুলত রুপোর ঝুনঝুনি কাঁটা। আর সেই থেকেই গান কে ভাললাগা। মা'ই আমার গানের প্রথম শিক্ষাগুরু। একটা পরিচ্ছন্ন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আমার বেড়ে ওঠা। সেই আমলে যখন হাতে গোনা দু একজনের বাড়িতে কলের গান, রেডিও কিংবা টেনজিসটার ছিল তখন আমাদেরও ছিল। আমরা গান শুনতাম। গৌহাটি , আকাশবাণী ,রেডিও সিলোন, বীনা কা গীতমালা ইত্যাদি । ঘুম ভাঙতো গান শুনতে শুনতে। সায়গল, রফি, নুরজাহান , মুকেশ নানা শিল্পীর গান বাজতো আর শুয়ে শুয়ে শুনতাম। সেই সকালটাই ছিল আমাদের অন্য রকম একটা সকাল। সেই ভাললাগা এক সময় প্রগাঢ় ভালবাসায় পরিণত হয়।
তখন কত আর বয়স। এই হবে চার কি পাঁচ। একদিন বাবা আমাকে আর বড় বোন আর ভাইকে নিয়ে গেলেন কিশোরগঞ্জ আর্ট কাউন্সিলে। ওখানে নাচে আমাদের ভর্তি করে দিলেন। শুরু হল নাচ শিখা। বিরাজবাবুর ছোট মেয়ে সবিতাদি, ইন্দ্রাণীদি, লাকী আপা ( লাকী ইনাম) তার বোন লুসি আপা, ডলি আপা, কথা ভৌমিক আরো অনেকে ছিল সবার নাম আজ আর মনে নেই। তবে আমি আর কথা ছিলাম সবার ছোট। নাচের ফাঁকে ফাঁকে গানের ক্লাসে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। বিপুলদা গান শিখতো তখন। কী অপূর্ব গলা।
আমাদের নাচের ওস্তাদ ছিলেন সমর দাশ। তিনি কলকাতা থেকে আসতেন। সপ্তাহে দুদিন ক্লাশ নিতেন , তখন থাকতেন বিরাজ কাকার বাসায়। ( জমিদার বিরাজ বাবু )। মাঝে মাঝে উনার বাসায় রিহার্সাল হত। তখন কি যে আনন্দ হতে আমাদের। জমিদার বাড়ি যাওয়া। কী বিশাল এক ফটক তার ভেতরে মস্ত বড় বড় দালান। লাল চকচকে চওড়া লম্বা বারান্দা। তাতে সকালের রোদ এসে লুটোপুটি খেত। আহ্লাদে গড়িয়ে পড়তো। মাসীমারা হাতের তালায় পিতলের থালা বাসন নিয়ে ঘাট পাড়ে যাওয়ার দৃশ্য আজো চোখে ভাসে। পরনে থাকতো লাল চড়া পাড়ের সাদা শাড়ি , কপালে সিঁদুরের বড় টিপ , পিঠ জুরে ভেজা চুল। হিন্দু ঘরের বৌ ঝিরা স্নান না করে আগুন ধরায় না! তাদের ব্যস্ত চলাফেরা ছিল দেখার আনন্দ। নাড়ু লাড্ডু খাওয়া চলতো , যেন অমৃত। আসল দালানে উঠিনি কখনো , নিষেধ ছিল। মুসলমানদের উঠতে দিত না। বিরাট আঙিনাতেই আমরা ছুটাছুটি করতাম। কত গাছ গাছালি আর ফুলের বাগান। ভেতরে একটা পুকুরও ছিল। তাতে শান্ত , স্থির ঘন সবুজ জল। শান বাঁধানো ঘাট। মা নিষেধ করে দিতেন যেন পুকুরের কাছে না যাই। তবু এই উৎসুক্য হৃদয় শুধু গভীর ভাবে টানতো ঐ কালো দিঘীর জল। আর একজন শিক্ষক ছিলেন চকলেট ভাই। তিনিও নাচ শিখাতেন ঢাকা থেকে এসে। উনার নামটা এমন কেন ছিল জানি না । তবে কি চকলেট বেশি খেতেন বা পছন্দ করতেন ? কি জানি বাপু। থাক ও কথা।
আমার স্টেজে প্রথম নাচ ছিল নজরুলের একটা গানের সাথে। " লাল টুকটুকে বৌ যায় গো , লাল নটের খেতে গো..... "। আমি মেয়ের অংশটা করেছিলাম আমার বন্ধু কথা ছেলের অংশটা। এই নাচের জন্য বাবা একটা নতুন লাল শাড়ি কিনে এনেছিলেন। এখন বিপত্তি হল , এক রত্তি মেয়েকে বার হাত শাড়ি পড়াতে গিয়ে । শাড়ি অর্ধেক ভাজ করে পরানো হল। জীবনে স্টেজে কত উঠেছি , এখনও একটু টেনশন থাকে কিন্তু সেদিন ছিল না। নাচ শেষ হতেই বারণ করা সত্ত্বেও আমি পর্দা সরিয়ে নিচে নেমে আসি। বাবা , মা সবার সামনে সোফায় বসা ছিলেন। আমি বাবার কোলে বসে আপা আর ভাইয়ের নাচ দেখলাম। ওখানে সবাই আমাকে বাহবা দিতে লাগল। গাল টিপে আদর করতে লাগল আর আমার বিরক্তি বাড়তে লাগল। কোথায় দু' ঠোঁট একত্র করছি না যাতে লিপস্টিক উঠে না যায় আর তারা সব যেন নষ্ট করে দিচ্ছে । যত তারা হাত বাড়ায় , তত আমি মুখ সরাই।
কিন্তু ঐ ! গান তো হল না । সেই কষ্ট রয়েই গেল। তবে খালি গলায় সারাক্ষণই গান গাইতাম। বিনা শিক্ষায় তখন থেকেই নিখুত ভাবে যে কোন গান গাইতে পারতাম। সারাক্ষণ গান গাইতাম। এ নিয়ে কত বকা খেয়েছি। আজানের সময় গান করো না, কেউ এলে গান করো না, পড়ার সময় না। শুধু না আর না। কিন্তু সেই দোষ আজও যেন কাটলো না। এখনও গান গাইতে গাইতে কাজ করি , রান্না করি , বাগান করি যেন বেশি শক্তি সঞ্চার করে আমায়। কিছু কথা গানে গানে বলি।
যখন ক্লাস ফোর এ উঠি। তখন এই চেনা শহরকে ফেলে চলে যাই চিটাগংগে। গান শেখা হলো না । মনের মাঝে সে বেদনা অহরহ বাজে। তবে ছোটবেলা থেকেই তাল , লয় ভাল বুঝতাম । তার কারণ এগুলো নাচেও লাগে। লতা জি আর সাবিনার খুব ভক্ত ছিলাম। ওদের গান আমার ধ্যান জ্ঞান ছিল। এক সময় ভাবতাম , ইস সত্যি যদি ওদের মত হতে পারতাম।
তবে যে কোনখানে কাউকে সফল দেখলে মুগ্ধ আমি। বাসের ড্রাইভার বাস চালাচ্ছে। তখন মনে হয় , আরে এই তো হিরো। এত গুলো লোকের সেই মুহূর্তে সেই তো হেফাজতকারি। কী দৃঢ় মনোবল নিয়ে শক্ত হাতে গাড়ি চালাচ্ছে, বাইরে তার কঠিন দৃষ্টি । তার সামান্য ভুলে যে কোন সময় ঘটতে পারে অঘটন। ভাবতাম সবাইকে আপন জায়গায় পৌছে দেয়ার পর নিশ্চয়ই সে পরম শান্তি উপভোগ করে। আমি বাস থেকে নামার আগে সব সময় ধন্যবাদ জানাই , তার ড্রাইভিং এর প্রশংসা করি। সচারাচর কেউ করে না। তখন তার মুখটা অনেক কিছুর চেয়ে দামী মনে হতো। একটা উদাহরণ দিলাম। যাক আবার গানে যাই। কীভাবে চেষ্টা চরিতার্থ হল সে এক লম্বা কাহিনী।
অনেকটা নিয়মের মতই ছিল , বাবা চেম্বার থেকে ফিরে ভাত খেয়ে শুয়ে আমাদের ডাকতেন, কাজ একটাই গান গাও। তো এই কাজটা আমিই বেশি করতাম। গান গাচ্ছি তো গাচ্ছি একসময় বাবা ঘুমিয়ে গেলে । আস্তে করে উঠে পালাতাম। কারণ বেশিক্ষণ এক জায়গায় বসে থাকার পাত্রী আমি নই । এটাই আমার স্বভাব। গতিময়তা আমার জীবন , হোক না তা যতই দোষের। আমি না হয় ব্যতিক্রমই হলাম।
[দুই]
সুরের মুর্ছনা যেখানে সেখানেই আবিষ্ট এই মন। সন্ধ্যাবাতি জ্বলে উঠার আগেই আশপাশ থেকে ভেসে আসতো সুরের লহরী। বিমূর্ত সেই সুরের সাথে আমারও হারিয়ে যাওয়া। কতদিন এভাবে কারো গান শুনতে শুনতে সন্ধ্যা কে করেছি আলিঙ্গন ।
তিন বছর পর আবার আমরা চিটাগংগ থেকে কিশোরগঞ্জ ফিরে আসি। এস , ভি স্কুলে ভর্তি হই। স্কুলের ফাংশনে টুকটাক গান করলেও , সেভাবে গান শিখতে পারছি না এই এক কষ্ট । তাই আমার মন সব সময়ই বিষণ্ণ থাকতো। মনের মাঝে শুধু একটাই স্বপ্ন লালিত হত হারমোনিয়াম বাজিয়ে কবে গান গাইতে পারবো।
আমার বাবা একজন প্রগতিশীল ও আধুনিক মানুষ হলেও পরিবারে বাবাই তো শেষ কথা না। নাচ শিখতাম বলে দাদাদের আপত্তি ছিল। তাই খুব বেশিদিন নাচ করতে পারিনি। তখন মুসলমান ঘরের মেয়েরা খুব একটা আসতো না । ' পুজারিনী ' নৃত্যনাট্যই ছিল আমার স্কুল জীবনের শেষ নাচ। আমি বধূ অমিতার অংশটা করেছিলাম
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই জানলাম। বাড়িতে হারমোনিয়াম আসছে আর সেই থেকেই অপেক্ষা। প্রতিদিন বাবা চেম্বার থেকে ফিরলে , দৌড়ে যেতাম। দেখতাম , রিক্সা থেকে বাবা নামছেন সঙ্গে কিছু নেই । মনটা খারাপ হয়ে যেত।
সব জল্পনা , কল্পনার অবসান ঘটিয়ে একদিন স্বপ্ন আমার সত্যি হল। বাবা এক বিরাট কাঠের বাক্স বন্দি করে নিয়ে এলেন তাকে। বাড়ি সুদ্ধ সবাই আমরা মহাখুশি। জার্মান ডবল রীডের হারমোনিয়াম এখন আমাদের বাড়ির অংশ । সকাল বিকাল বোনেরা পে পু করে শুধু সা রে গা মা বাজাই। তখন অবশ্য আমি আর আপ্পাই ( আপা ) এর দাবীদার। টুকটাক বাজাই। একজন ছাড়লে আর একজন ধরি। রীতিমত কাড়াকাড়িও হয়। কিছুদিন শিখলামও। একটু একটু করে চলছে গান।
এরি মাঝে সব কেমন যেন ওলটপালট হয়ে গেল। সারা দেশে চলছে তখন রাজনৈতিক অস্থিরতা । দিনদিন অবস্থার অবনতি হতে লাগল। পঁচিশে মার্চের কালো রাতে গণ হত্যার মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ। হারমোনিয়ামকে আবার বাক্স বন্দি করে রাখা হল। শহর জুড়ে এক থমথমে পরিবেশ। বাইরে লোকজনের তেমন চলাফেরা নেই। সবাই ভীত সন্ত্রস্ত । বাবা কান লাগিয়ে বিবিসির খবর , আকাশবাণী কোলকাতার খবর , স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর শোনেন। আমাদের স্কুল যাওয়া বন্ধ, বন্ধ হল বিকেলে মাঠে গিয়ে খেলাধূলা। সবাই ঘরেই থাকি। কিশোরগঞ্জ শত্রুমুক্ত তখনও। একদিন খুব বিষণ্ণ মুখে বাবা বাড়ি ফিরলেন। তেমন কিছু বুঝি না, বাবা বললেন , কিশোরগঞ্জে পাকিস্তানি আর্মি নামছে। পরদিন সেই চেনা শহরের রূপ রাতারাতি পাল্টে গেল। এক এক করে সবাই শহর ছেড়ে চলে যেতে লাগল। পাড়াময় একটা শূন্যতা। কারফিউ, ব্ল্যাক আউট এগুলো তো আছেই। একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ। পাড়াটা আস্তে আস্তে প্রায়শূণ্য হয়ে গেল। আর থাকা যাচ্ছিল না । সারাক্ষণ ভয় আর ভয়। একদিন সব ফেলে কটা কাপড় চোপড় নিয়ে আমরাও তৈরি। চলে যাবো। প্রশ্ন উঠল , হারমোনিয়াম নিয়ে। বাবা কিছুতেই নিবেন না। এই কাঠের যন্ত্রটা যেন কাল হয়ে দাঁড়াল। এটাই যেন পাকিদের শত্রু বা তার মালিক তাদের শত্রু।
এক সকালে সব ফেলে বিশেষ করে হারমোনিয়ামটাকে ফেলে আমরা চলে গেলাম গ্রামের বাড়িতে। একটা ছেলে ছিল আকবর , ও রাতে গিয়ে থাকতো। সারা শহর তখন শুনশান। হাতে গোনা কিছু লোক থাকত যদিও তেমন চলাফেরা করত না। আকবর সাইকেল চালিয়ে বিকেলে যেত রাতের খাবার নিয়ে আর সকালে ফিরতো । সেদিন সে চিৎকার করে কি বলতে বলতে আসছে উদ্ভ্রান্তের মত । তা দেখে বাবার সাথে আমরাও বাংলাঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাদের দেখে সে কাঁদতে লাগল । বলল , নানা সব শেষ। বাসা লুট হয়ে গেছে । কিচ্ছু নেই । আমরা সবাই থ। বললাম ,
- আমার হারমোনিয়াম ?
- নাই । নাই , কিচ্ছু নাই!
[তিন]
" মোর বীণা ওঠে কোন সুরে বাজি ,
কোন নব চঞ্চল ছন্দে ".... ।
না , আমার কোন বীণা নব ছন্দে বেজে ওঠেনি। হারমোনিয়াম হারিয়ে যে কষ্ট তাও একদিন তামাদি হয়ে গেল কালের স্রোতে। ব্যস্ত হয়ে উঠলাম SSC exam নিয়ে। তারপর পেলাম স্বপ্নের কলেজ জীবন। দেখতে দেখতে তাও কেটে গেল। আবার ব্যস্ততা HSC নিয়ে । কিন্তু কোথাও যেন একটা বিশাল শূন্যতা তো ছিলই ।
মা চলে যাওয়ার পর সেই শূন্যতা আরো প্রগাঢ় হয়ে উঠলো। বিষণ্ণতায় ভরা দিনগুলোতে শুধু টিকে থাকার সংগ্রাম। শ্রীহীন ঘরদোর , এক সাগর দুঃখ, কষ্ট , আর যন্ত্রণা ভরা এক জীবন যে এমনি কেটে যাবে আজ ভাবতেও অবাক লাগে।
মাত্র বিশ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে গেল। যে বাড়িতে গেলাম। ওখানে গান বাজনার কোন চর্চাই নেই। বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে। ও বাড়ির ছেলেরা খুব ভদ্র , শান্ত, আদর্শবান। ওরা শুধু পড়াশুনা করে। মা , বাবার বাধ্য ছেলে সব । এতগুলো বসন্ত যার সাথে কাটালাম তাকে কোনদিন গান গাইতে দেখলাম না। অন্তত বেসুরা গলায় গান গাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে বিরক্তির কারণ হয়ে ওঠেননি আমার কাছে । আপাতত এটুকুনিই শান্তি । তবে এ ব্যাপারে আমাকে কখনো বাঁধাও দেননি। কদর করেছেন বরাবর।
কিছুদিন পর আমরা বিদেশে চলে যাই। সুদূর নাইজেরিয়াতে। ওখানে ফ্রি ফারনিস্ট বাড়ি। যেখানে বালিশ , মশারিও কিনতে হয়না। সেদিনের সেই সংসারে প্রথম যেটা কিনেছিলাম , তা হল ডাবল ক্যাসেটের ক্যাসেট প্লেয়ার। ঢাকা থেকে প্রচুর ক্যাসেট নিয়ে গিয়েছিলাম। আবার জরিয়ে গেলাম ভালবাসার গানে। কাজ নেই। সারাদিন গান আর গান। শোনা আর গাওয়া। পাঁচ বছর পর ছিয়াশি সালে আবার আমরা দেশে ফিরে এলাম। বড়মেয়ে সবে হয়েছে। পোস্টিং হল নেত্রকোনা। ওখানে যাব। হঠাৎই মনে হল , ওখানে একা একা কী করব। কাউকে তো চিনি না। ঠিক যাওয়ার দুদিন আগে সুরবিতান থেকে আমার দ্বিতীয় হারমোনিয়াম কেনা। আবার বাক্স বন্দি করে ঘরে তোলা। একি রকম ছিল আনন্দটা। যেটা আজও আমার সাথে ঘুরেছে নানান জায়গায়। আজ তারও স্থায়ি অবস্থান আমার সাথে। আমি চলে গেলেও ও হয়তো থাকবে আরো কিছুকাল । তারপর ? সে প্রশ্নের উত্তর আমারও জানা নেই ।
নেত্রকোনায় প্রথম বাসাটা তেমন ভাল ছিল না। স্যাঁতস্যাঁতে ভাব। এক মাস থেকে বাসা পাল্টাই। দ্বিতীয় বাসাটি খুব আরামদায়ক ছিল। দোতলা বাসা , খুব খোলামেলা, আলো বাতাসে ভরপুর। তিনদিকে বারান্দা। সারাক্ষণ শুধু বাতাসের খেলা চলে। নিচে কারা যেন থাকত জানি না । মেস বাড়ি হবে হয়তো । ভোররাতে কে যেন রেয়াজ করত। আর ঠিক তখনি আমার ঘুম ভেঙে যেত। রাগ ইমন , ভৈরবি, বেহাগ আরো কত কী। সেই ছোট্ট বেলার মত শুয়ে শুয়ে শুনতাম। ঘুলঘুলিতে একটু আলো দেখলেই বিছানা ছেড়ে একাকী বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতাম আর ভাবতাম , কে গায়। সে কেমন দেখতে ?অনেক লোকের ভীরে তাকে আর চেনার সুযোগই হয়নি। লোকটা গান গায় তাতে মনে হত কোন সুশীল, ভদ্র, মার্জিত লোক তো হবেই। কারণ আমার ধারণা বরাবর শিল্পী মাত্রই রুচিশীল কোন লোক। ভরাট গলায় রাগ ইমনের আলাপে ভরিয়ে তুলতো সকালটাকে। সকালের নির্মল বাতাসের মত সে আলাপ আমায় বহুদূর নিয়ে যেত।
তারপর চলে আসি সাতপাই। সেখানেই উস্তাদ গোপাল দত্তের কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীত ও নজরুল গীতির তালিম নেয়া শুরু করি। তখন আমি একজনের মা। ওর বাবা তখন মেয়েকে রাখতো। উস্তাদজী খুব নামকরা ছিলেন। রেডিও টিভির প্রথম শ্রেণীর শিল্পী। উনার কাছে প্রথম গান তুলি " মেঘের ডমরু ঘন বাজে.... "। দুবছর পর ময়মনসিংহ চলে আসি। তালিম নেই প্রথমে নারায়ণ দাস স্যারের কাছে । উনি কোলকাতা চলে গেলে শুরু করি উস্তাদ সুনীল ধরের কাছে। উনার কাছে শিখতে শিখতেই বড় মেয়ে সাত বছরের হলে সেও উনার কাছে শুরু করে গান শিখা। তারপর ছোট মেয়ে হল , সেও সাত বছর বয়সে সেও বসলো , শিখলো। এক লম্বা জার্নি। মঙ্গলবারে আসতেন সন্ধ্যায় , দশটা এগারোটা বেজে যেত যেতে যেতে । ওরা আগে করত। আমি চা নাস্তা পান দিয়ে শেষে বসতাম। গান ছাড়াও কত গল্প হত। এক সময় ঘরের মানুষ , কাছের মানুষ হয়ে উঠলেন। পচিঁশ বছর ! এতগুলো বছর একসাথে সুখে দুখে কেটেছে। এত বয়স তবু আমায় ম্যাডাম বলে ডাকতেন। পঁচিশ বছর এত সাথে ছিলেন। গত বছর মারা যান।যেন রক্তের কাউকে হারালাম , এমন মনে হয়েছিল সেইদিন। গোপাল দত্ত জীও মারা যান শুধু জানি না নারায়ণদার কথা। তিনি ইন্ডিয়া চলে গিয়েছিলেন। আসার সময় ব্যস্ততার জন্য উস্তাদজীর সাথে দেখা করে আসতে পারিনি। ইচ্ছে ছিল দুইমেয়ে কে নিয়ে নাতি সহ একবার গিয়ে দেখে আসবো। সে সুযোগও হল না।
ঢাকা এসে সব বন্ধ । খালি গলায় ভাজি কিছু গান। এখন হারমোনিয়ামের ধুলো ঝারি, হাত বুলাই । কিন্তু আগের মত টানে না। এটা নিয়ে বসিও না। তবল জোড়ার অবস্থাও খারাপ । শুধু এটুকুই শান্তি ওরা আছে আমার ঘর আলো করে।
[সমাপ্ত]
লেখিকা: বেবীনাজ করিম, একজন অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষিকা ও ছোট গল্পকার। ইতোমধ্যেই তাঁর দুটো গল্পগ্রন্থ 'ত্রিধারা' ও 'সম্পর্ক' প্রকাশিত হয়েছে এবং যথেষ্ট পাঠক-সমাদর পেয়েছে।