বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪

| অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

পরীক্ষামূলক

হাওর বাংলা প্রতিদিন.কম || HaorBangla Protidin.com

গোপদিঘী গ্রামের সংস্কৃতির কিছু কথা

ডাঃ তামান্না আক্তার

প্রকাশিত: ০২:৩৭, ২০ এপ্রিল ২০২১

আপডেট: ০৬:১৩, ২৫ এপ্রিল ২০২১

গোপদিঘী গ্রামের সংস্কৃতির কিছু কথা

গোপদিঘী গ্রামটি কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইন থানার অন্তর্গত একটি প্রাচীন জনপদ। বহুকাল পূর্বে অত্র এলাকা কামরূপ শাসনাধীন ছিল এবং কোচ উপজাতীয় বংশধরগণ এখানে জনপদ গড়ে তোলে। এ গ্রামটি 'গড়াভাঙ্গা' নদীর তীরে অবস্থিত।গড়াভাঙ্গা নদীর নামকরণের  জনশ্রুতি আছে যে নদীটি খুবই খরস্রোতা ছিল এবং জনৈকা কূলবধু কলসি (গড়া) নিয়ে জল ভরতে গেলে স্রোতের টানে কলসি শক্ত কোন বস্তুর সাথে ধাক্কা লেগে ভেঙ্গে যায়।সেই থেকেই নাকি 'গড়াভাঙ্গা' নামের উৎপত্তি হয়। আবার এমন জনশ্রুতিও আছে যে প্রবল স্রোতস্বিনী ছিল বলেই নদীর এ কূল ভেঙ্গে ও কূল গড়তো। এই ভাঙ্গা-গড়া থেকেই 'গড়াভাঙ্গা' নদী নামের উৎপত্তি হয়।

নদীমাতৃক এই বাংলাদেশে গোপদিঘী আমাদের জন্মভূমি। বহু যুগ আগে মসনদে আলি বীর ঈশা খাঁ কর্তৃক কোচ রাজা লক্ষণ হাজরার জঙ্গলবাড়ি রাজধানী দখল হওয়ার পর এতদাঞ্চলের কোচ উপজাতীয় বসতি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হলে হিন্দু সম্প্রদায় অত্র এলাকায় বসবাস শুরু করে। হিন্দুদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল 'গোপ' সম্প্রদায়। তারা এখানে পানীয় জলের আধার হিসেবে বড় বড় দিঘী তৈরি করেছিল। যার কারণে গোপদের তৈরি দিঘী থেকে এই বৃহৎ গ্রামটি গোপদিঘী নামে পরিচিতি লাভ করে।আঞ্চলিক কথ্য ভাষায় কেউ কেউ  গোপদিঘীকে 'গোয়ালদিঘী'ও বলে থাকে।

কথিত আছে যে, সম্রাট নাসির উদ্দিন নসরত শাহ ভাটি অঞ্চলসহ আসাম রাজ্য জয় করেছিলেন। তখন থেকেই মুসলমান জনগোষ্ঠী গোপদিঘী গ্রামে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে। হিন্দু-মুসলমান অধ্যুষিত এ গ্রামটি প্রাচীন কাল থেকে ধর্মনিরপেক্ষ সাংস্কৃতিক পীঠস্থান হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। গোপদিঘী গ্রামে একটি গায়েনপাড়া ছিল (এখন ও আছে), যা গায়েনহাটি নামে পরিচিত। এই গায়েন সম্প্রদায়ই গোপদিঘী গ্রামের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের প্রথম ও প্রধান উৎস ছিল। প্রধানতম গায়েনদ্বয় ছিলেন- খোয়াজ গায়েন ও চন্ডীচরণ গায়েন।

আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে শেখ কাউছার বয়াতি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জারি, সারি, পালাগান ও কিসসা গাইতেন।তার সুরেলা কন্ঠ সকলকে সহজে মুগ্ধ করতো। কাউছার বয়াতি ছিলেন ইব্রাহীম বয়াতির ওস্তাদ। ধারাবাহিকভাবে  গোপদিঘীর সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের নাম দেওয়া হলো- খোয়াজ গায়েন, চন্ডিচরণ, কাউছার বয়াতি, ইব্রাহিম বয়াতি, দুলাই মুন্সি, অধর আচার্য, প্রমোদ রঞ্জন চক্রবর্তী, যামিনি দেবনাথ, সুধীর দেবনাথ, অনিল ভূষণ রায়, ডাঃ নুরুল হক ভূইয়া (মতি মাস্টার)। বিশেষ করে ইব্রাহিম বয়াতি যাকে "বিশ্ব নন্দিত পুরুষ" হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তার পালাগান ''মাধব মালঞ্চী কইন্যা" থেকে আমাদের সংস্কৃতি বিশ্বদরবারে পরিচিতি লাভ করে। এই কথাগুলো একটু না বললেই নয়।

এই পালাগান থেকে আমরা জানতে পারি আড়াইশত বৎসর পূর্বের বাংলার সমাজচিত্র সম্পর্কে। উল্লেখ্য যে ইব্রাহিম বয়াতির জন্ম মিঠামইন থানার গোপদিঘী ইউনিয়নের খাশাপুর গ্রামে। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা জানতেন না। তিনি একাধারে ৩০ বৎসর ময়মনসিংহ, সিলেট, নেত্রকোনা ও আসামের নোয়াগাঁও জেলার বিভিন্ন স্থানে এই পালাগানটি গেয়েছেন।তার পালাগান শুনে মুগ্ধ হয়ে কিশোরগঞ্জ বিন্নগাও নিবাসী ও বাঙলা একাডেমির প্রখ্যাত লোকগীতি সংগ্রাহক প্রয়াত মোহাম্মদ সাইদুর গোপদিঘী এসে বয়াতির কাছ থেকে 'মাধব মালঞ্চী কইন্যা'র কাহিনি পান্ডুলিপি করে বাংলা একাডেমিতে সংরক্ষিত করে রাখেন। পরবর্তীতে কলকাতার বিশিষ্ট নাট্যকার বিভাস চক্রবর্তী এ কাহিনীকে নাট্যরূপ দান করেন। তারপর কলকাতার 'অন্য থিয়েটার রঙ্গমঞ্চে' একাধারে ১৪০ রজনী এ গীতিনাট্য সগৌরবে মঞ্চায়িত হয়। উপচে পড়া দর্শক এ নাটকটি উপভোগ করেন।কলকাতা সিটি কর্পোরেশন অজ্ঞাত কারণে এক সময় এ নাটক প্রদর্শন বন্ধ করে দেয়।ইব্রাহিম বয়াতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য ইউরোপীয় 'Folklore Society' কর্তৃক প্রেরিত পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের নেতৃত্বে বিভাস চক্রবর্তী ও মোহাম্মদ সাইদুর কিশোরগঞ্জ এসে তদানীন্তন মহকুমা প্রশাসকের নিকট থেকে যাবতীয় তথ্যাবলী সংগ্রহ করেন।

বিগত ১৯৯০ সালের অক্টোবর মাসে বাংলা একাডেমির ফোকলোর বিভাগের পরিচালক একটি দল নিয়ে মিঠামইন সদর ও গোপদিঘী আসেন। এ সময়ে গোপদিঘীতে বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ডাঃ নুরুল হক ভূইয়া (মতি মাস্টার) তাঁদের সম্মানে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এই স্কুল শিক্ষক ও হোমিও চিকিৎসক আজীবন নিজগ্রামে নিজ বাড়িতে থেকে শিক্ষকতা ও গণচিকিৎসার পাশাপাশি 'হাওর পল্লী ও লোকজ সংস্কৃতি'র একনিষ্ঠ সেবা করে গেছেন। তিনি ১৯৮৪ সালে 'ইব্রাহিম বয়াতি সাংস্কৃতিক সংঘ' গঠন করেন এবং তিনি এই সংঘের আজীবন সভাপতি ছিলেন।
ডাঃ নুরুল হক ভূঁইয়া (মতি মাস্টার)'র পরিচালনায় বাংলাদেশে প্রথম 'মাধব মালঞ্চী কইন্যা' পালাটি নাট্যাকারে গোপদিঘী হাইস্কুল মাঠে মঞ্চায়িত হয়। এসব অনুষ্ঠানমালা সংরক্ষণ ও গবেষণার জন্য ভিডিও ধারণ করে নিয়ে যান ইউরোপীয় লোকসাহিত্য সমাজ 'Folklore Society'। 'Folklore Society' কর্তৃক এই গীতিনাট্যটি শ্রেষ্ঠ লোকনাট্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

ভারতীয় উপমহাদেশের 'ভোলানাথ অপেরা'র খ্যাতিমান অভিনেতা বাবু অধর আচার্য, বিশিষ্ট সুরকার, গীতিকার,  নাট্যাভিনেতা ও চিত্রকর বাবু প্রমোদ রঞ্জন চক্রবর্তী, ভোলানাথ অপেরার স্বনামধন্য অভিনেতা বাবু সুধীর রঞ্জন দেবনাথ, বিশিষ্ট অভিনেতা নরেন্দ্র সরকার, বিশিষ্ট কবি, লেখক ও অভিনেতা মেজবাহ উদ্দীন আহম্মেদ, বিশিষ্ট নাট্যপরিচালক, অভিনেতা এবং নাট্যকার ডাঃ নূরুল হক ভূঁইয়া(মতি মাস্টার), যাঁদের প্রচেষ্টায় ১৯৬৪ সালে গোপদিঘী জিন্নাতুন্নেছা হাইস্কুল প্রাঙ্গনে একটি 'স্থায়ী থিয়েটার মঞ্চ' গড়ে উঠেছিল। এই 'থিয়েটার মঞ্চ' স্থাপনে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন তৎকালীন স্থানীয় ভূস্বামী ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান দানবীর ইসহাক ভূঁইয়া, যিনি জিন্নাতুন্নেছা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন। উক্ত থিয়েটারে টিকিটের ব্যবস্থা ছিল। তাতে যে অর্থ উপার্জন হতো তা দিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হতো।অভিনেতাগণ কোন প্রকার পারিশ্রমিক নিতেন না। তারা  জনসেবার কাজে নিয়োজিত থাকতেন। উক্ত থিয়েটারের পরবর্তী প্রজন্ম বা অভিনেতাগণ হলেন - নরেন্দ্র সরকার, আবদুল আহাদ মাস্টার, হীরা লাল রায়, কমল রঞ্জন মজুমদার, খুর্শিদ উদ্দিন ভূঁইয়া, দ্বিজেন্দ্র মজুমদার প্রমুখ। তাদের হাত ধরে আরও কিছু অভিনেতার আবির্ভাব ঘটে। তাঁরা হলেন-  ইসলাম উদ্দিন মাস্টার, রবীন্দ্র সূত্রধর, অঞ্জন কুমার সরকার, আলাউদ্দিন হায়দার, আশরাফ আহাম্মেদ, ইন্দ্রজিৎ সূত্রধর, শরফ উদ্দিন ভূঁইয়া, শহর আলী মাস্টার, ফাইজুল আলম, জসিম উদ্দিন, আবুল কালাম, ফরিদ উদ্দিনসহ আরও অনেকে।

১৯৮৪ সালে কিশোরগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে জেলা শহরে উৎসবমুখর পরিবেশে এক নাট্য প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এতে মোট ১২টি দল অংশগ্রহণ করে। গোপদিঘী জে.এন. হাইস্কুল দলটি 'জিতেন বসাক' রচিত ও ডাঃ নুরুল হক ভূঁইয়া (মতি মাস্টার) পরিচালিত 'দায়ী কে?' নাটকটি এ প্রতিযোগিতায় মঞ্চস্থ করে প্রতিযোগিতায় বিজয়ী ও পুরস্কৃত হয়। গোপদিঘী জে.এন. হাইস্কুল থিয়েটার দলের সাথে আনোয়ার হোসেন, রাণী সরকার, সুবাস দত্তের মতো জাতীয় পর্যায়ের চলচ্চিত্র অভিনেতাদের সম্বলিত দলগুলোও এই প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়েছিল, যা এখনও গোপদিঘীর মানুষ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। এই দলের মঞ্চায়িত নাটকগুলোর মধ্যে ঐতিহাসিক, সামাজিক, স্বাধীনতাযুদ্ধের নাটকগুলো অন্যতম। মঞ্চায়িত নাটকগুলো হলো বাগদত্তা, টিপু সুলতান, সিরাজ উদ-দৌলা, শাহজাহান, বেদেকন্যা, দায়ী কে,
আবির ছড়ানো মুর্শিদাবাদ, বর্গী এলো দেশে, একটি পয়সা, অশ্রু দিয়ে লেখা, গলি থেকে রাজপথ, নন্দ রাণীর সংসার, এ পৃথিবী টাকার গোলাম, মা মাটি মানুষ, কে দেবে জবাব, এক মুঠো আগুন, মন্দির থেকে মসজিদ, নিচু তলার মানুষ, এক মুঠো অন্ন চাই, জীবন নদীর তীরে, রক্ত নদীর বাঁধ, বেঁদের মেয়ে পঞ্চি, প্রেমের সমাধি তীরে, মাধব মালঞ্চী কইন্যা, রক্তাক্ত বাংলা, গণহত্যার কসাই, জেলভাঙ্গা কয়েদি ও রাজাকারের ফাঁসি।

আজও আমরা নতুন প্রজন্মকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি। আবারও গোপদিঘী গ্রামের সন্তানেরা জয়ের মালা পড়ে সকলের মুখ উজ্জ্বল করবে। স্বনামধন্য নাট্যকার ও শিক্ষাব্রতী ডাঃ নুরুল হক ভূঁইয়া অসংখ্য সুযোগ্য শিষ্য রেখে গিয়েছেন। তিনি ২০১৮ সালের ১৩ ই আগস্ট এ পৃথিবীর মায়া ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন। তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখা ও গ্রামের অতীত কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে  টিকিয়ে রাখার জন্য গঠন করা হয়েছে "মতি মাস্টার শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সংঘ" এবং এ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল। বর্তমানে এই সংঘের উন্নয়নে কাজ চলছে। সবার সহযোগিতা কামনা করছি।

 

[এই প্রবন্ধের ঐতিহাসিক তথ্যসমুহ মরহুম ডাঃ নুরুল হক ভূঁইয়ার বিভিন্ন সময়ের লেখা প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি থেকে সংগৃহীত।] - লেখিকা।

লেখিকা: তামান্না আকতার, প্রয়াত নাট্যগুরু ডাঃ নুরুল হক ভূঁইয়া (মতি মাস্টার)'র সুযোগ্যা কন্যা এবং একজন বিশিষ্ট হোমিও চিকিৎক, স্কুল শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক কর্মী। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে উচ্চশিক্ষিত এই নারী বাবার গ্রামের বাড়িতেই অবস্থান করেন ও লোকজ সংস্কৃতির চর্চা ও প্রচারে নিয়োজিত।- সম্পাদক

    আরো পড়ুন